আপনি কি নিজেই রিটার্ন তৈরি করে জমা দিতে চাচ্ছেন?
আপনি কি জানেন ব্যক্তি করদাতাদের কর গণনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে?
এই পরিবর্তনগুলো ভালোভাবে না জেনে আয়কর গণনা করা হলে কর গণনা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আজকে এই লেখায় ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আলোচনা করা হবে।
প্রতি বছরই বাজেটে কিছু পরিবর্তন আসে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আপনি ২০২১-২২ আয় বছরে যে আয় করেছেন তার রিটার্ন দাখিল গত জুলাই মাসের ০১ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে। জরিমানা ছাড়া আপনি আগামী ৩০ নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত আপনার রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।
আপনি যদি ঝামেলাহীনভাবে রিটার্ন দাখিল করতে চান তাহলে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রিটার্ন তৈরির কাজ শুরু করতে পারেন। তবে নতুন করদাতার জন্য এই বছর বাড়তি সুবিধা রয়েছে। তারা রিটার্ন দাখিল করার জন্য একটা দীর্ঘ সময় পাচ্ছেন।
নতুন করদাতার কর দিবস ৩০ জুন ২০২৩
আপনি যদি নতুন করদাতা হয়ে থাকেন তাহলে আপনার জন্য এবার রিটার্ন দাখিল করার শেষ দিন হলো ৩০ জুন ২০২৩। সাধারণত ব্যক্তি করদাতা প্রতি বছর কর দিবসের মধ্যে আয়কর বিবরণী দাখিল করে থাকেন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ নভেম্বর কর দিবস পালিত হয়ে আসছে। তাই ব্যক্তি করদাতাকে এই দিনের মধ্যে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হয়।
কিন্তু অর্থ আইন ২০২২ অনুযায়ী, নতুন করদাতার আয়কর রিটার্ন দাখিলের শেষ দিন ৩০ নভেম্বর ২০২২ না হয়ে ৩০ জুন ২০২৩ হবে। এতে করে যারা নতুন করদাতা, আগে কখনোই রিটার্ন দাখিল করেননি, তারা বাড়তি সময় পেলেন।
তাই আপনি যদি এই বছর নতুন করদাতা হয়ে থাকেন, তবে আপনি চাইলে ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে যে কোনো সময় আপনার রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। রিটার্ন দাখিল করার জন্য দরকারি যে কাগজপত্র এবং প্রস্তুতি দরকার, তা সম্পন্ন করতে আপনার যদি সময় লাগে তাহলে আপনি নিশ্চিন্তে ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে পারেন।
পূর্বের ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করলে যা করতে হবে
তবে কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। আপনি পূর্বের বছরগুলোতে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার জন্য যোগ্য ছিলেন। কিন্তু করেননি। সেক্ষেত্রে আপনাকে আলাদা দুইটি সময়ের মধ্যে আয়কর বিবরণী দাখিল করতে হবে। ধরুন, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ এবং ২০২১-২২ আয় বছরগুলোতে আপনার করযোগ্য আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করেছে। কিন্তু আপনি রিটার্ন দাখিল করেননি। এক্ষেত্রে কিন্তু আপনি সবগুলো আয়কর রিটার্ন ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে জমা দিতে পারবেন না।
প্রথমে আপনাকে ৩০ নভেম্বর ২০২২ এর মধ্যে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ এই দুই বছরের ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে হবে। আর ৩০ জুন ২০২৩ এর মধ্যে ২০২১-২২ আয় বছরের আয়কর বিবরণী দাখিল করতে পারবেন। তবে আপনি যদি চান, তাহলে একসাথে তিন বছরের রিটার্ন ৩০ নভেম্বর ২০২২ এর মধ্যে দাখিল করে দিতে পারেন। এতে করে দুইবার ট্যাক্স রিটার্ন নিয়ে কাজ করতে হবে না। আপনি ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার পর ট্যাক্স রিটার্ন প্রাপ্তিস্বীকারপত্র বা ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট যত্ন করে রেখে দিন।
সেবা পেতে হলে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দেখাতে হবে
আয়কর বিবরণী দাখিল করার প্রমাণ সংরক্ষণ করা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ- এখন থেকে কিছু সেবা পেতে গেলে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ প্রদর্শন করতে হবে। আগে টিআইএন দাখিল করতে হতো। কিন্তু এই বছর থেকে নতুন নিয়মমতো আপনাকে কাজ সমাধান করতে হবে। যদি কোনো ব্যক্তি রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হন তাহলে উল্লেখিত সেবা থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন নতুবা আয়করের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে।
কোন কোন সেবা পেতে আয়কর বিবরণী দাখিলের প্রমাণ লাগবে?
তার একটি তালিকা আয়কর আইনে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো –
- কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে পাঁচ লাখ টাকার অধিক লোন নিতে চাইলে
- সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়ন করতে চাইলে
- ক্রেডিট কার্ড প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে চাইলে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তি ও বহাল রাখতে চাইলে
- পাঁচ লাখ টাকার অধিক পোস্ট অফিস সঞ্চয়ী হিসাব খুলতে চাইলে
- পাঁচ লাখ টাকার অধিক সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে ইত্যাদি।
এসব কাজ যদি আপনি করতে চান, তাহলে এখন থেকে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ দেখাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আপনার মনে হতে পারে, রিটার্ন দাখিল করলেই ট্যাক্স দিতে হবে। আসলে বিষয়টা তা না। আপনি আইন মানার জন্য রিটার্ন দাখিল করছেন কিন্তু আপনার আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম না করলে আপনাকে রিটার্ন দাখিল করার সময় কর দিতে হবে না।
করমুক্ত আয়ের সীমা কার জন্য কত?
একজন পুরুষ করদাতার জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা তিন লাখ টাকা এবং মহিলা করদাতার জন্য সাড়ে তিন লাখ টাকা। যদি এই সীমা অতিক্রম করে তাহলে আপনাকে কর দিতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আপনার আয় যদি একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম না করে তাহলে আপনি মাত্র এক পৃষ্ঠার একটি রিটার্ন ফরম পূরণ করে ট্যাক্স সার্কেল-এ জমা দিলেই হবে।
রিটার্ন দাখিল করার প্রমাণ হিসেবে ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নিতে হবে ?
আপনি ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট না নিলেও চলবে। আপনি রিটার্ন দাখিল করার সময় যে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পাবেন তা দিয়েই কাজ চালাতে পারবেন।
করের পরিমাণ হ্রাস করার উপায়
ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার আগে আপনি যে কর গণনা করেন, তখন করের পরিমাণ দেখে মনে হতে পারে অনেক বেশি কর এসেছে। কিন্তু এই করের পরিমাণ হ্রাস করার উপায় হলো বিনিয়োগ ভাতা। আপনি যদি কিছু নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ বা দান করেন তাহলে কর রেয়াত দাবী করতে পারবেন, যা আপনার করদায় বহুলাংশে কমাবে। কিন্তু এইবার বিনিয়োগ ভাতার সীমা এবং কর রেয়াত গণনায় পরিবর্তন এসেছে। বিনিয়োগ ভাতার সীমা হ্রাস পেয়েছে।
একটু আগে জেনেছেন, করদায় কমানোর উপায় হলো বিনিয়োগ বা দান। তাই বিনিয়োগ বা দান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে আপনাকে এই বিনিয়োগ বা দান আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতে করতে হবে। যদি তা না হয়, তাহলে আপনি যতোই বিনিয়োগ বা দান করেন না কেন, আপনি কিন্তু ঐ বিনিয়োগ বা দানকৃত টাকার উপর কর রেয়াত দাবী করতে পারবেন না। তাই আপনি বিনিয়োগ বা দান করার আগে আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতগুলো জেনে নিন। এবং চেষ্টা করুন, সারা বছর ধরেই এই বিনিয়োগ বা দান করতে। তা না হলে শেষ দিকে চাপ পড়তে পারে।
নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে আয়কর গণনায় দেখাতে পারবেন
আপনি যে বিনিয়োগ বা দান করবেন, তার একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে আয়কর গণনায় দেখাতে পারবেন। আগে একজন ব্যক্তি করদাতা তার করযোগ্য আয়ের ২৫% পর্যন্ত বিনিয়োগ ভাতা দাবী করতে পারতেন। কিন্তু এবার তা কমে ২০% পর্যন্ত করা হয়েছে। এর ফলে সকল করদাতার বিনিয়োগ ভাতার পরিমাণ কমে যাবে, যার ফলে কর রেয়াতও কমবে।
আপনি যখন বিনিয়োগ ভাতার সীমা নির্ধারন করবেন তখন মোট তিনটি সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট সংখাটি হবে আপনার বিনিয়োগ ভাতা, যার উপর আপনি কর রেয়াত গণনা করবেন। এই তিনটি সংখ্যা হলো, এক. করযোগ্য আয়ের ২০%, দুই. আপনার প্রকৃত বিনিয়োগ অথবা তিন. এক কোটি টাকা। এই তিনটি অংকের মধ্যে যে অংকটি ছোট হবে সেটাই হবে আপনার বিনিয়োগ ভাতা। এই বিনিয়োগ ভাতার উপরই আপনি কর রেয়াত গণনা করবেন।
কর রেয়াত গণনায় পরিবর্তন এসেছে
আগে কর রেয়াতের হার ছিলো দুইটি। ব্যক্তি করদাতার করযোগ্য আয়ের পরিমানের উপর নির্ভর করে কর রেয়াতের হার নির্ধারন হতো। যদি কোন ব্যক্তি করদাতার করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হতো তাহলে বিনিয়োগ ভাতার উপর ১৫% হিসেবে কর রেয়াত দাবী করতে পারতেন। আর যদি কোন করদাতার করযোগ্য আয় ১৫ লাখ টাকা অতিক্রম করতো তাহলে কর রেয়াত হার হতো ১০%। এর ফলে যাদের আয় বেশি ছিলো, তারা কম কর রেয়াত সুবিধা পেতেন।
কিন্তু এবার দুইটি কর হার বাদ দিয়ে একটি কর হার ঠিক করা হয়েছে। এতে করে সকল শ্রেণীর করদাতা ১৫% হিসেবে কর রেয়াত সুবিধা পাবেন। যাদের আয় বেশি তারা এর ফলে বেশি সুবিধা পাবেন। তবে কর রেয়াত গণনা আগের চেয়ে সহজ হলো। একটা হার ব্যবহার করে এখন আপনি কর রেয়াত গণনা করতে পারবেন। আপনি ইতোমধ্যেই জেনেছেন, কর রেয়াত আপনার করদায় অনেকাংশে হ্রাস করে থাকে। কিন্তু এই কর রেয়াতের পরিমান অর্ধেক মনে যেতে পারে যদি আপনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল না করেন।
৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিলে ব্যর্থতায় কর রেয়াত ৭.৫%
কর দিবসের মধ্যে রিটার্ন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে করদাতা কিছু সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। কোনো করদাতা যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে জরিমানা দিতে হয়। যেমন – করদায়ের উপর মাসিক ২% হারে সুদ দিতে হয়। আর এখন থেকে উক্ত সুদের পাশাপাশি কর রেয়াতের পরিমাণ কমবে অর্ধেক।
আপনি যদি ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন দাখিল না করেন তাহলে কর রেয়াত ১৫% এর স্থলে ৭.৫% হিসেবে পাবেন। এতে করে আপনার কর রেয়াত অর্ধেক কমে গেলো যার ফলে আপনার করদায় বেড়ে যাবে। তাই চেষ্টা করুন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিটার্ন দাখল করতে। তবে নতুন করদাতার জন্য এইবার কর দিবস কিন্তু ৩০ জুন ২০২৩।
শেষকথা
এতোক্ষণ ধরে আপনি গুরুত্বপূর্ণ ৫টি পরিবর্তন সম্পর্কে জানলেন। এর মধ্যে শেষের তিনটি পরিবর্তন আপনার আয়কর গণনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। যদি কোনো একটি ক্ষেত্রে ভুল হয় তাহলে আপনার আয়কর গণনা ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। এছাড়াও আপনি কর রেয়াত সুবিধা পেতে হলে আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতে বিনিয়োগ বা দান করতে হবে।
এসকল বিষয় একসাথে যদি পাওয়া যায় তাহলে অনেক সুবিধা হয়। এজন্য আপনি “ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারেশনঃ কমপ্লিট গাইড ২০২২” বইটি দেখতে পারেন। ট্যাক্স রিটার্ন তৈরি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ধাপে ধাপে প্রতিটি কাজ উদাহরণসহ আলোচনা করা হয়েছে। বইটি পড়ে আপনি খুব সহজে নিজেই নিজের রিটার্ন তৈরি করতে পারবেন।
আরও পড়ুন- মার্কেটিং-এর ২২ টি সূত্র, যা মানলে ব্যবসায় উন্নতি নিশ্চিত!
“ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারেশনঃ কমপ্লিট গাইড ২০২২” বইটি কিনতে ক্লিক করুন