জীবনে চলার পথে অনেক কাজ, অনেক বন্ধু, অনেক বাধা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ ছেড়ে যায়, কেউ থেকে যায়। কিছু কাজ হয়, কিছু হয় না। কিছু বাধা আমরা সরাতে পারি, কিছু পারি না। তাই বলে দমে যাব? না, না, না। নতুন বছরে দোকানী খোলে নতুন হিশেবের বই, স্কুলে শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষ, অফিসগুলোও নতুন করে ভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও থাকা চাই কিছু পরিকল্পনা, কিছু লক্ষ্য এবং সেই সঙ্গে থাকুক লক্ষ্য পূরণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ। কিন্তু কেমন হয়, যদি এবার ভাবা যায় একটু অন্যরকম করে? আমি নিজের জন্যে যেভাবে ভেবেছি, মিলিয়ে দেখুন তো আপনার ক্ষেত্রে এগুলো কোনো উন্নয়ন ঘটাতে পারে কিনা?
১। ফ্যাশন নয়, অনুসরণ করব প্যাশনকে
ফ্যাশন আমাদের অনেক কিছুই বলে। কিন্তু আমরা সবচে ভালো থাকি তখনই, যখন নিজের ভালো লাগার এবং ভালোবাসার কাজটিকে ঘিরে কিছু করতে পারি। আমি বলছি না, আপনি ডিজাইনিং ভালোবাসেন বলে এখনই ব্যাংকের চাকরিটি ছেড়ে দিন। সেটা একেবারেই কোনো কাজের কথা নয়। কিন্তু আপনি যদি ডিজাইনিং ভালোবাসেন, এটাকে ঘিরে আপনার মাথায় দিন-রাত নানান যন্তর-মন্তর চলতে থাকে, তাহলে এই ভালোবাসাটিকে জিইয়ে রাখার জন্য পদক্ষেপ নিন এবছর। আমার একটি আঁকাআঁকি বিষয়ক ব্যক্তিগত ব্যবসায় উদ্যোগ আছে। এ বছর আমি সেটাতে বিশেষভাবে মনো্যোগী হওয়ার পরিকল্পনা করেছি। যদি এমন হয়, আপনি এখনো কোনো ক্যারিয়ারে প্রবেশ করেননি, তাহলে আরও বৃহৎভাবে সুযোগ রয়েছে আপনার প্যাশনকে ঘিরে কিছু করার। ট্রাই ইট!
২। ফিট থাকার জন্য ডায়েট এবং ব্যায়াম করব, চিকন হওয়ার জন্য নয়
ডায়েট এবং ব্যায়াম করার লক্ষ্য অনেকেরই এইজন্য থাকে যে, তারা খুব দ্রুত ওজন কমাতে চায় বা পাতলা হতে চায়। এটা করতে গিয়ে অনেকেই ভুলভাল ডায়েট বেছে নেয়, এতে কারো কারো হিতে বিপরীত হয় অবস্থা। কিন্তু ডায়েট এবং ব্যায়ামের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হতে হবে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকা। আপনি যদি প্রতিদিনের অস্বাস্থ্যকর খাবারগুলোর জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়ে আসেন, সেভাবেই আপনার খাওয়ার ইচ্ছে বা ক্ষুধা মেটান, তাহলে তা আপনার শরীরকে ইতিবাচক দিকে নিয়ে যাবে। আপনি সুস্থও থাকবেন। আর সপ্তাহে তিন-চার দিন আধা ঘন্টার ব্যায়াম, তা ঘরে হলেও, অনেক উন্নতি ঘটাবে শরীর এবং মানসিক অবস্থার। এতে করে একটু ধীরে ধীরে ওজন কমলেও হুট করে পুনরায় ওজন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকবে না। আমি আমার ডায়েট প্ল্যান এবার এভাবেই করেছি। গত বছর একটা বিশেষ ডায়েট করে এক মাসে ৭ কেজি ওজন কমিয়ে আমার কোনো লাভ হয়নি। দৈনন্দিন সুঅভ্যাস না থাকার কারণে ওজন বেড়ে গেছে আবারও, রোগ-ব্যাধিও বাসা বেধেছে প্রতিদিনের ব্যায়াম ছেড়ে দেয়ায়।
৩। একটা বা দুটা নতুন কোর্স করব
জীবনকে বাঁচাতে হলে আমাদের প্রয়োজন জীবিকা। আর জীবিকার প্রতিযোগিতায় তারাই সবচে এগিয়ে থাকবেন, যারা হবেন দক্ষ এবং ভবিষ্যৎমুখী। সেই হিসেবে একটা বা দুটা নতুন কোর্স আপনার ঝুলিতে যোগ করবে অনেক বেশি কিছু। আমি আমার কাজ সম্পর্কিত দুটো কোর্স করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি কী কী কোর্স করবেন, ভেবেছেন কিছু? যারা একেবারেই নতুন, তারা মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট এগুলো দিয়ে শুরু করতে পারেন।
রকমারি থেকে পরিবেশিত কোর্সসমূহ দেখুন
৪। অযথা কথা, পরনিন্দা এবং গুজব থেকে দূরে থাকব
দোষে-গুণে মিলিয়েই মানুষ। তা সত্ত্বেও খারাপ দিকগুলো সংশোধনের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কথা সময় নষ্ট করে, আর প্রাসঙ্গিক কথা ভালো কিছুর জন্ম দেয়। অনেক কিছু শিখতেও সাহায্য করে। আমি বলছি না, পরিবারের মানুষদের সঙ্গে গাল-গল্প, দুষ্টুমি, ঠাট্টা এগুলো বাদ দিয়ে দিতে হবে। কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা আর আচরণের মূল্য আছে, যেগুলো সম্পর্ককে সুন্দর রাখে। কিন্তু কখনো কি ভেবে দেখেছেন, আমাদের কর্মক্ষেত্রে এগুলো অনেক সমস্যা তৈরি করে? কারো পেছনে তার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলা, কোনো গুজবে বিশ্বাস করা– এগুলো নানান ঝামেলা তো তৈরি করেই, সেই সাথে মানুষ হিসেবেও অন্যের কাছে অনেক নিচে নামিয়ে দেয় আমাদের। তাই আমি এই ব্যাপারগুলো মেনে চলার চেষ্টা করব। কোনো সংবাদ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কোনো ভাইরাল পোস্ট দেখামাত্রই বিশ্বাস করব না এবং শেয়ার করব না। আগে যাচাই করে নেব তার সত্য-মিথ্যা। কারণ- ঐ সংবাদ বা ভাইরাল পোস্টটি যদি মিথ্যে হয়, তা অনেকের দুর্ভাবনা ও দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। গুজব যত ভালো উদ্দেশ্যেই ছড়ানো হোক না কেন, এগুলো দিয়ে শেষ পর্যন্ত আদৌ কোনো মঙ্গলকর কিছু হয় না।
৫। প্রতিদিন অন্তত একটি প্রশংসা করব
প্রশংসাই জন্ম দেয় আরও নতুন নতুন সুন্দরের। তাই কেউ ভালো কিছু করলে তাকে উৎসাহিত করার জন্য তার কাজের প্রশংসা করব। প্রতিদিন অন্তত একটা করে প্রশংসা করব। এভাবেই আমার দৈনন্দিন অভ্যাসের অংশ হয়ে যাবে এটি। এই অভ্যাসটি নিজের মধ্যে ধারণ করার উদ্দেশ্যে এটা আমার এবছরের লক্ষ্যগুলোর একটি ।
৬। দয়া ও সহানুভূতিমূলক অন্তত একটি কাজ প্রতিদিন করব
দয়া ও সহানুভূতির সামান্য একটু পদক্ষেপও আমাদের চারপাশটাকে আরও সুন্দর করে তুলতে পারে। আমি জানলাম কেউ অনাহারে আছে, তার জন্য খাবার নিয়ে গেলাম; রাস্তার একটা কুকুরছানাকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম; রাস্তা পার করে দিলাম একজন অক্ষম জনকে, এমন অনেক কিছুই হতে পারে। হতে পারে কাউকে একটা স্থায়ী কর্মের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য কিছু টাকা দিলাম; বুভুক্ষের মতো খাবারের দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে যে পথশিশুরা, তাদের কাউকে একটা পছন্দের খাবার কিনে দিলাম; মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করলাম নিজের ঘরের কাজে। প্রতিদিন রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে ভাবব, আজ সারাদিনে অন্তত একটি এরকম কোনো কাজ করেছি কিনা। ক্যারিয়ার উন্নয়নের পাশাপাশি মানবিক দিক উন্নয়নের অনুশীলনও সব সময় জারি রাখব, এটা আমার নতুন বছরের অঙ্গীকার।
৭। বই পড়ার অভ্যাস জারি রাখব
বই পড়ার অভ্যাস একটা সাংঘাতিক ভালো অভ্যাস। গবেষকরা বলছেন, এটা যে শুধু আপনার জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে তা নয়, আপনার মনোযোগ এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিতে বই পড়ার বিশাল ভূমিকা আছে। জানেন? ডাক্তাররা তো আজকাল স্মৃতিভ্রংশ রোগের ওষুধ হিসেবে বই পড়ার অভ্যাসকেই আগে আনছেন! আবার হতাশা, বিষন্নতা, মানসিক চাপ থেকেও মুক্তি দিতে বইয়ের মতো বন্ধু কম আছে। তাই আমি ঠিক করেছি প্রতিদিন চার পাতা করে হলেও বই পড়ব, কিন্তু প্রতিদিন পড়ব। সেটা একটা রূপকথার বই হোক, ভালো কোনো ধর্মীয় বই হোক, কোনো মোটিভেশনাল বই হোক কিংবা হোক কোনো প্রবন্ধের বই, আপত্তি নেই কোনোটিতেই। যারা বইয়ের দিকে একেবারেই ঘেঁষেন না, তারা খুব সহজ আর মজার কোনো বই দিয়ে এই যাত্রাটা শুরু করতে পারেন। এক বছর এই অনুশীলন করেই দেখেন, এটা একটা ম্যাজিক! আমি অতীতেও এই ম্যাজিকের প্রমাণ পেয়েছি। কিছুকাল বিরতি দেয়ায় অভ্যাসে কিছুটা ভাটা পড়েছে, তাই প্রতিদিন অন্তত কিছুটা সময় বই পড়ায় বরাদ্দ রেখে অভ্যাসটা ফিরিয়ে আনতে চাই এবছর। একই সাথে আমার আশেপাশে যারা আছে, তাদেরকেও বই পড়ার উপকারিতা সম্পর্কে বলব। বই কিনব এবং অন্যকেও বই উপহার দেব।
আরও পড়ুন-বই পড়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?
২০২১ এর ৫টি বেস্ট সেলার উপন্যাস
ছোটদের বই , কিন্তু বড়দেরও পড়া উচিত অবশ্যই! (১ম পর্ব)
৮। প্রয়োজন নেই, এমন কিছু কিনব না
কেউ কেউ ব্যতিক্রম আছেন হয়তো। আমি তাঁদের শ্রদ্ধা ও সালাম জানাই। কিন্তু এই ব্যাপারটা আমাদের অধিকাংশের মধ্যেই কম-বেশি আছে, ঠিক তো? অপ্রয়োজনীয় জিনিস ঝোঁকের মাথায় কিনে মাথা চাপড়ান, এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আমি এবছর থেকে এই ব্যাপারে সতর্ক হয়ে যাব। হুটহাট কোনো কিছু কেনার আগে চিন্তা করে দেখব, জিনিসটা আমার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা। প্রয়োজন না থাকলে কিনব না। টাকাটা রেখে দেব অন্য কোনো প্রয়োজনীয় খাতে খরচ করার জন্য।
৯। টাইম ম্যানেজমেন্ট শিখব
বাসার কাজ, অফিসের কাজ, এই কোর্স, সেই কোর্স, নিজের কোনো ব্যবসা…সবকিছু মিলিয়ে আমাদের প্রায়ই মনে হয়, কত ভালো হত যদি ৩৬ ঘন্টায় একদিন হত, তাই না? কিন্তু আমার মনে হয়, সময়কে যদি আমরা ম্যানেজ করতে শিখে যাই, সময় নিয়ে আর মোটেই হাহাকার করতে হবে না। ডেডলাইন ঠিকঠাক রেখে আমাদের কাজগুলোও সম্পন্ন হবে সুন্দরভাবে। এ বছর এটা আমার অনেক বড় একটা লক্ষ্য। টাইম ম্যানেজমেন্ট বুঝে প্রতিটি কাজ করব। টাইম ম্যানেজমেন্ট বুঝে কিভাবে কাজ করা যাবে সেটা লেখক ব্রায়ান ট্রেসি খুব সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন নিচের বইটিতে-

১০। ভ্রমণ করব
মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রকৃতির মতো ভালো ডাক্তার আর কে আছে? মন যতোই খারাপ থাকুক, একটা ঝকঝকে আকাশ, একটা কাশফুলের বন, ঝর্ণার জলের কলকল শব্দ, কী অদ্ভুত শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় মনে! যে কারণে কাজ থেকে ছোট ছোট ছুটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ই কাছে-দূরে ভ্রমণ করি আমি। যথারীতি এবছরেও সেটা পরিকল্পনায় আছে। এমনকি কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব, সেটাও প্রাথমিকভাবে ঠিক করা আছে। আপনি কোথায় যাবেন?
আরও পড়ুন- বছর শেষে কোথায় ঘুরতে যাবেন , জানা আছে?
আমার সঙ্গে কতটা মিলেছে আপনার, কিংবা কতটা মিলতে পারত, জানি না। কিন্তু আপনি নতুন কোনো ভাবনা আমার পরিকল্পনার তালিকা থেকে পেতেও পারেন। কিংবা নিজেই করে ফেলুন নিজের মতো পরিকল্পনার তালিকা। আর তালিকা বানিয়ে বসে থাকলে চলবে না। বাস্তবায়নের শতভাগ চেষ্টাও জারি রাখতে হবে। আচ্ছা, এটা আমার তালিকার ১১ নম্বর পয়েন্ট—হাহাহা! সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। নতুন বছর কাটুক সুন্দরে, সৃজনে ও আনন্দে।
আত্মোন্নয়নমূলক বইগুলো দেখতে ক্লিক করুন