এমন একটা সময় ছিল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েও এদেশের তরুণরা সিএসপি (বিসিএস এর পূর্ব নাম) অফিসার হতে চাইত । গত ৪০-৫০ বছরে সময় অনেক বদলে গেছে, দেশে এখন স্মার্ট কর্পোরেট কালচারও শুরু হয়েছে, ঔপেনিবেশিক ধ্যান-ধারণা, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন, পর্যাপ্ত গবেষণার সুযোগের অভাব ইত্যাদি নানা কারণ (কিংবা অজুহাতে) এখন এদেশের সর্বাধিক মেধাবীরা বিদেশ গমনকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আর যারা দেশের মায়া ত্যাগ করতে পারে না, তাদের অনেকেই আবার থিতু না হবার আশঙ্কা থেকে নব্য কর্পোরেট কালচারে নিজেদের সংমিশ্রন ঘটাতে পারে না, কিংবা আরও নানা জানা-অজানা কারণে দুপয়সার সরকারি চাকুরি করার বাসনা লালন করে, তারা অতি স্বাভাবিকভাবেই বিসিএস এর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
কাজেই যারা সব বিচার-বিবেচনা করে বিসিএস এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন, বিদেশে নাগরিকত্ব নেওয়ার বাসনা বাদ দিয়েছেন, গেটস/ জবস/ জুকারবার্গ সাহেবদের মতো হওয়ার কিংবা রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন বাদ দিয়েছেন, তাদের জন্যই মূলত আজকের এই লেখা।
বিসিএস দিতে এসে প্রথমেই অধিকাংশ লোক যে ভুলটা করে তা হচ্ছে ক্যাডারগুলো সম্বন্ধে একটি নূন্যতম ধারণা নেওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি না করা। বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করার শিক্ষাগত, শারীরিক ও অন্যান্য যোগ্যতা পূরণ করতে পারলে আপনি যে বিষয়েই স্নাতক/স্নাতকোত্তর করুন না কেন, সাধারণ ক্যাডার তালিকার সবই পছন্দক্রমে রাখতে পারবেন। কিন্তু প্রফেশনাল/টেকনিক্যাল ক্যাডার তালিকা থেকে কোন কোন ক্যাডার পছন্দ তালিকায় রাখার সুযোগ পাবেন, তা নির্ভর করবে আপনার স্নাতকে পঠিত বিষয়ের ওপর। যেমনঃ এমবিবিএস/বিডিএস ডিগ্রি সম্পন্ন করা প্রার্থীরা প্রফেশনাল ক্যাডার হিসেবে শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডার পছন্দের তালিকায় রাখতে পারবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করা প্রার্থীরা প্রফেশনাল ক্যাডার হিসেবে পরিসংখ্যান ও শিক্ষা ক্যাডার রাখতে পারবেন। আবার, পুরাকৌশল (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং) সম্পন্ন করা প্রার্থীরা টেকনিক্যাল/প্রফেশনাল ক্যাডার তালিকায় গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল প্রভৃতি ক্যাডার রাখতে পারবেন (কারণ- ওপরের চার ক্যাডারের নিয়োগের শিক্ষাগত যোগ্যতায় পুরাকৌশল বিষয়ের কথা বলা আছে)।
আরও পড়ুন- ‘বিসিএস’ ভালো করতে জানতে হবে যে সকল উপায়
-
ক্যাডার বণ্টন প্রক্রিয়া
বিসিএস পরীক্ষার মূল ধাপ তিনটি। ২০০ নম্বরের এমসিকিউ পদ্ধতির প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, এরপর ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা এবং ২০০ নম্বরের ভাইভা। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সব চাকরিপ্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে লিখিত পরীক্ষায় ৫০ শতাংশ নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীরা ভাইভায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান। ভাইভায়ও পাস নম্বর শতকরা ৫০ ভাগ। লিখিত ও ভাইভায় প্রাপ্ত নম্বর যোগ করে একটি মেধাতালিকা তৈরি করা হয় ক্যাডার বণ্টনের জন্য।
এরপর এই মেধাতালিকা অনুসারে বেশি নম্বরপ্রাপ্ত থেকে ক্যাডার বণ্টন শুরু করে পিএসসি। যিনি সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছেন, তিনি প্রথমে সুযোগ পাবেন। তাঁর চয়েস অনুযায়ী প্রথম চয়েসের ক্যাডারটি তিনি পাবেন। এক্ষেত্রে তাঁর প্রথম চয়েস যদি সমবায় ক্যাডার হয়, তিনি সমবায় ক্যাডার পাবেন; আবার প্রথম চয়েস যদি পররাষ্ট্র ক্যাডার হয়, তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডার পাবেন।
প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে ক্রমানুসারে তাঁদের পছন্দের ক্রম (ক্যাডার চয়েস) অনুযায়ী ক্যাডার পেতে থাকবেন। সব ক্যাডার পদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে। এবার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পস্ট হবে —
১। ধরুন, যিনি প্রথম হয়েছেন, তাঁর পছন্দের ক্রম কাস্টমস, পররাষ্ট্র, পুলিশ, তথ্য ইত্যাদি। যেহেতু তাঁর সিরিয়াল আগে, তিনি আগে সুযোগ পাবেন এবং যেহেতু এখনো কোনো পদ বণ্টিত হয়নি, সেহেতু তিনি প্রথম পছন্দ কাস্টমস ক্যাডার পাবেন।
২। আরেকজনের কথা বিবেচনা করি, তাঁর ক্যাডার পছন্দক্রম এ রকম — প্রশাসন, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস, পুলিশ, তথ্য ইত্যাদি। মনে করি, তিনি ৪০০তম। এবার ক্যাডার বণ্টনের সময় দেখা গেল প্রশাসন ক্যাডারের পদ বণ্টন শেষ। এরপর দেখবে প্রার্থীর দ্বিতীয় পছন্দ অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস আছে কি না? যদি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারে তখনো পদ থাকে তাহলে তিনি অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডার পাবেন। আর যদি না থাকে তাহলে তাঁর তৃতীয় পছন্দ ‘পুলিশ’ দেখাবে। এভাবে প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে।
৩। আরেকজনের কথা বিবেচনা করি, পছন্দক্রমে তিনি শুধু তিনটি ক্যাডার দিয়েছেন — পুলিশ, কর, কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজ। মনে করি, যখন তাঁর সিরিয়াল এলো, তখন ওপরের তিনটি ক্যাডারের পদ পূরণ হয়ে গেছে। খালি আছে তথ্য, খাদ্য, সমবায় ক্যাডারের পদ। এক্ষেত্রে যেহেতু তাঁর পছন্দক্রমে এসব ক্যাডার নেই, সেহেতু তিনি কোনো ক্যাডারই পাবেন না।
৪। ধরুন, একজনের পছন্দক্রম — প্রশাসন, স্বাস্থ্য, পুলিশ ও কর। অর্থাৎ, তিনি সাধারণ ও প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল উভয় ক্যাডারে আবেদন করেছেন। সাধারণ ক্যাডারে যখন তাঁর সিরিয়াল আসবে, তখন দেখবে প্রশাসন ক্যাডারের কোনো পদ খালি আছে কি না। যদি থাকে — তাহলে তিনি প্রশাসন ক্যাডার পাবেন। যদি না থাকে — তখন তাঁর প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডারের সিরিয়াল বিবেচনা করা হবে। যদি সেখানে পদ খালি থাকে, তাহলে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডার পাবেন। যদি খালি না থাকে তখন আবার সাধারণ ক্যাডার বিবেচনা করা হবে। তখন প্রথমে দেখা হবে পুলিশ ক্যাডারের পদ খালি আছে কি না? এভাবে ক্রমানুসারে বিবেচনা করা হয়।
৫। কেউ যদি শুধু প্রফেশনাল বা টেকনিক্যাল ক্যাডারে (স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রকৌশল, কৃষি ইত্যাদি) আবেদন করেন, তাহলে ক্যাডার বণ্টনের ক্ষেত্রে তাঁর সংশ্লিষ্ট ক্যাডারটিই বিবেচনা করা হবে। তিনি কোনো সাধারণ ক্যাডার পাবেন না (মেধাতালিকা অনুযায়ী পদ খালি থাকলেও)।
-
ক্যাডার চয়েসের সময় বিবেচ্য বিষয়
ক্যাডার পদ কিভাবে বণ্টন করা হয় — এটা বুঝতে পারলে ক্যাডার চয়েস বা পছন্দক্রম ঠিক করা সহজ হয়ে যাবে। ক্যাডার চয়েসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো — নিজের আগ্রহ, পরিবার, চাকরির সুযোগ-সুবিধা, কর্মপরিবেশ, কর্মস্থল, পঠিত বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্ক, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে অগ্রাধিকার নির্ধারণ করা। ক্যাডারগুলো সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সমাজে প্রচলিত আছে। আবার, আমাদের সামাজিক বাস্তবতা ও অন্যান্য কারণে অনেক চাকরিজীবী চাকরিতে যোগদানের পর হতাশায় ভোগেন।
পছন্দক্রম নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো ভালোভাবে বিবেচনা করে অনলাইনে আবেদন করার আগে একটা খসড়া করে নেওয়া ভালো। ক্যাডার চয়েস দেওয়ার সময় চিন্তা করবেন — আপনার সামনে সব ক্যাডার রাখা আছে। সব কিছু বিবেচনা করার পর আপনি কোন চাকরিটি করতে চান, সেটি ১ নম্বরে দিন। ১ নম্বরের চাকরিটি না পেলে কোন চাকরিটি করতে চান, সেটি ২ নম্বরে দিন। এভাবে আপনি যে চাকরিগুলোর যে কোনোটি হলেই করবেন সব লিস্টে রাখবেন। যে চাকরিগুলো করার সুযোগ পেলেও আপনি করবেন না, শুধু সেগুলো বাদ দেবেন। যেমন ধরুন, এরই মধ্যে আপনি ভালো একটি চাকরি করছেন। পররাষ্ট্র বা প্রশাসন ক্যাডারে কাজ করার আগ্রহ আপনার, অন্য কোনো চাকরি হলেও করবেন না, সে ক্ষেত্রে শুধু এই দুটি ক্যাডারই পছন্দক্রমে রাখবেন। কিন্তু যে কোনো চাকরি হলেই করবেন, সে ক্ষেত্রে সব ক্যাডারই আগ্রহের ক্রমানুসারে লিস্টে রাখবেন।
অনলাইনে আবেদন করার সময় আবেদন ফরমে ব্যক্তিগত তথ্য (পার্ট-১) ও শিক্ষাগত যোগ্যতার তথ্য (পার্ট-২) পূরণ করার পর আপনার পছন্দক্রমে রাখতে পারবেন — এ রকম সব ক্যাডারের তালিকা (পার্ট-৩) স্ক্রিনে আসবে। আপনার কাজ হবে ক্যাডারগুলো থেকে পছন্দের একটা ক্রম তৈরি করা।
ক্যাডার চয়েস দেওয়ার সময় বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদের সংখ্যা দেখার দরকার নেই। ‘এই ক্যাডারে পদ বেশি, এটা আগে দিব’ এ ধরনের চিন্তা করা বোকামি। আপনি চিন্তা করবেন — সব বিবেচনায় আপনার আগ্রহ কোনটিতে বেশি, পদসংখ্যা যা-ই হোক, সেটি আগে। ভাইভায় ক্যাডার চয়েস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ক্যাডার চয়েসের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো যাঁরা ভাইভা নেবেন, তাঁরাও জানেন। চয়েস দেখে তাঁরা আপনার বিবেচনাবোধ সম্পর্কে একটি ধারণা পাবেন। চেষ্টা করবেন আপনার চিন্তা যেন অদ্ভুত না হয়। আর ভাইভা বোর্ডে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চয়েস থেকেই বেশির ভাগ প্রশ্ন করা হয়ে থাকে। ক্যাডার চয়েসের ক্রম নিয়ে ভাইভায় প্রশ্ন করা হলে একটি যৌক্তিক কারণ বলার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
-
বিভিন্ন ক্যাডার সম্পর্কে ধারণা
★ পররাষ্ট্র ★
যেদিন থেকে পৃথিবীতে শাসনতন্ত্র শুরু হয়েছে তার পরপরই শুরু হয়েছে কূটনীতি, আর সবসময়ই কূটনীতিক প্রতিনিধিরা সর্বাধিক শিক্ষিত, মেধাবী ও প্রজ্ঞা সম্পন্ন হয়ে থাকেন ।
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- এই ক্যাডারে সাধারণত খুব কম খালি পোস্ট থাকে তাই প্রতিযোগিতা সবচেয়ে বেশি।
- জয়েন করার পর থেকে ঢাকায় পররাস্ট্র মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং, বিদেশে পোস্টিং হতে অন্তত ৬-৭ বছর বা কাছাকাছি লাগে, বিদেশে পোস্টিং হলে কূটনৈতিক সুবিধাসমূহ পাওয়া যায়।
- উচ্চ পদে গেলে এলিট জীবন যাপন করা যায়, বিদেশে পরিবার এমনকি চাকর পর্যন্ত নেওয়া যায় এবং পরিবারের সদস্যরা কূটনীতিক না হয়েও কূটনীতিকের মত মর্যাদা-সুবিধা ভোগ করেন (এমনকি ভৃত্য পর্যন্ত)।
- এই ক্যাডারে প্রমোশন গ্রোথ অনেক ভালো, কারণ- কম লোক নেয়া হয় আর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মিশন সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
- উচ্চ শিক্ষার সুযোগ অনেক ভালো, বর্তমান পররাস্ট্র সচিব একজন হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট।
- উচ্চ শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জাতিসংঘে প্রেষণে (ডেপুটেশনে) যাওয়ার সুযোগ থাকে; বিদেশে ট্যুর আছে প্রচুর।
- কাজের চাপ তুলনামূলক বেশি; সৎভাবে উন্নত জীবন-যাপন সম্ভব।
রাষ্ট্রদূত হয়ে কোনো দেশে জয়েন করলে এরা “গার্ড অব অনার” পান, যা সাধারণত প্রেসিডেন্ট/ সরকার প্রধানরা পেয়ে থাকেন । তবে দেশের মাটিতে এদের ক্ষমতার ব্যবহার সীমিত, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হারুন-অর-রশিদের মতে, “Foreign Cadres’ contribution to the country may not always be fully appreciated by the public in Bangladesh.” (কারণ তাদের কাজের খুব কম অংশই জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা হয়ে থাকে)।
★ প্রশাসন ★
নাম থেকেই বোঝা যায় এর কাজ, ক্যাডার সার্ভিস শুরুই হয়েছে বলতে গেলে এই ক্যাডার দিয়ে, এরাই মূলত দেশ চালনার মূল হাতিয়ার বলে থাকেন কেউ কেউ। একটা সময় প্রায় ৯০ ভাগ প্রার্থীই নাকি এই ক্যাডার প্রথম পছন্দে দিত (সূত্রঃ একজন অবসর প্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব), এমনকি এখনো প্রায় ৫০-৬০ ভাগ লোক তাই দেয় ।
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- মফস্বলে পোস্টিং এর সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, তাই জনগণের সাথে কাজ করার সুযোগও বেশি।
- চাকুরিতে ঢুকে ডিসি অফিসে কাজ করা লাগে, স্বল্প সংখ্যক অ্যাডমিন ক্যাডার অবশ্য মন্ত্রনালয়ে সহকারি সচিব হিসেবেও কাজ করে থাকেন।
- মোটামুটি ৭-৮ বছর পর UNO হওয়া যায়, আর একজন UNO কে উপজেলা পর্যায়ের সরকার নিয়োজিত ‘রাজা’ বললে মনে হয় কেউ কষ্ট পাবে না, কারণ UNO হলে বাংলো ও গাড়ি সুবিধা পাওয়া যায়, উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠান/সেমিনার/কর্মশালা ইত্যাদিতে গেস্ট/চিফ গেস্ট হিসেবে যাওয়া লাগে, উপজেলা পর্যায়ে ক্ষমতার ব্যবহার ব্যাপক।
- ডিসি’রা জেলা লেভেলের প্রশাসক, ডিসি’র কাজ ও সুবিধা সমূহ আশা করি সবাই জানেন।
- অ্যাডমিন ক্যাডারের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে — ভ্যারিয়েশন, এই ক্যাডারের লোকজন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ পান, এমনকি চাকুরি শেষ হলে যোগ্যতা ও দক্ষতার (ও রাজনৈতিক) ভিত্তিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও এরা এগিয়ে (যেমন পিএসসি’র মেম্বার/চেয়ারম্যান )।
- প্রচুর স্কলারশিপ থাকায় এদের বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ অনেক বেশি, উচ্চ শিক্ষা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাতে প্রেষণে (ডেপুটেশনে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, জাতিসঙ্ঘ, ইউনেস্কো, এডিবি ইত্যাদিতে) যাওয়ার সুযোগ অন্য সব ক্যাডারের চাইতে অনেক অনেক বেশি, উল্লেখ্য ডেপুটেশনে অনেক উচ্চ বেতন দেওয়া হয় (যেমনঃ জাতিসংঘে প্রারম্ভিক P-5 গ্রেড ইকুইভ্যালেন্ট প্রায় ১ লাখ ডলার)।
- এমনকি, পররাস্ট্র ক্যাডার না হয়েও অনেকে বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে কাজ করার সুযোগ পান, এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার রেকর্ডও এই ক্যাডারের লোকের আছে।
- এই ক্যাডারে অনেক লোক নেওয়ার কারণে প্রমোশন জটিলতা বেশি, তবে মূলত আশির দশকের ব্যাচগুলো বেরিয়ে গেলে এই ক্যাডারে প্রমোশন অনেক তরান্বিত হবে বলে সবাই আশা করছেন , তখন আর এই জটিলতা থাকবে না।
- এই ক্যাডারে কাজের চাপ ভালোই তবে দায়িত্ব অনুসারে কাজের চাপ নির্ভর করে।
- চাকুরির প্রথম জীবনে (৩-৪ বছর) বৈধ/ অবৈধ বাড়তি আয়ের সুযোগ কম।
- রাজনৈতিক চাপ অনেক বেশি, তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধেও অনেক সময় অনেক কাজ করা লাগতে পারে (উদাহরণঃ হরতালে মোবাইল কোর্ট )।
- এই ক্যাডারে যারা সাধারণত বেশি দিন চাকুরি করতে পারে (যেমনঃ প্রথম দিকে যারা বিসিএস দিচ্ছেন) তারাই বেশি লাভবান হয়, কারণ- তাদের উচ্চ পদে (সচিব বা তদূর্ধ্ব ) যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ( যদিও প্রমোশন আরও অনেকগুলো প্যারামিটারের উপর নির্ভর করে )।
★ পুলিশ ★
বাংলাদেশের মানুষ সারাদিন পুলিশকে ঠোলা ঠোলা বলে গালি দেয়, অনেকে ঘুষখোর বলে ঘৃণাও করে, কিন্তু দিন শেষে কিংবা রাত পোহালে কোনো বিপদে পড়লে এই পুলিশকেই যখন তখন ফোন দিতে বাধ্য হয়, এ থেকেই বোঝা যায়, পুলিশ আমাদের সমাজে কতটা প্রয়োজন — তারা কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- লজিস্টিক সাপোর্ট বেশ ভালো (যেমনঃ রেশন সুবিধা, গাড়ি সুবিধা, কোয়ার্টার সুবিধা)।
- এই ক্যাডাররা একবারে র-(Raw) পাওয়ার প্র্যাক্টিস করতে পারে।
- কাজের চাপ সবচাইতে বেশি (ঈদের দিনও ডিউটি থাকে)।
- উপরের দিকে (Ad. DIG থেকে IGP পর্যন্ত) পোস্ট কম হওয়ায় প্রমোশন গ্রোথ একটা লেভেলে গিয়ে আটকে যায়, দুর্বল চিত্তের লোকজনের এই ক্যাডারে না আসাটাই বেটার (According to an SP)।
★ কাস্টমস ★
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- কাস্টমস ক্যাডাররা অর্থ মন্ত্রণালয়ের IRD এর একটি ডিভিশন — NBR এর একটি উইং (কাস্টমস উইং) এর হয়ে কাজ করেন।
- এই ক্যাডারদের অ্যাডমিন/পুলিশ দের মত পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগও একেবারে কম।
- পোর্টে কাজের চাপ অনেক বেশি এমনকি অনেক সময় নিশ্বাস ফেলার জো থাকে না, তবে VAT এ তুলনামূলক (পোর্টের চেয়ে) কাজের চাপ কম;
- মানসিক চাপও অনেক বেশি থাকে।
- ঢাকার বাইরে পোস্টিং বেশি।
- বৈধ উপায়ে প্রচুর টাকা কামানোর সুযোগ রয়েছে, যেমনঃ চোরাচালান ও ফাঁকি ধরতে পারলে সরকারিভাবে মূল্যভেদে ১০ – ৪০ % পর্যন্ত পুরস্কার বা Grant of Rewards দেয়া হয়।
- লজিস্টিক সাপোর্ট বেশ ভালো, যেমনঃ গাড়ি ও বাসস্থান সুবিধা।
- প্রমোশন গ্রোথ অতিরিক্ত কমিশনার হওয়া পর্যন্ত অনেক ভালো, কিন্তু কমিশনার যুগ্ম-সচিব পদমর্যাদার হওয়ায় অনেকেই ডিএস লেভেলে গিয়ে স্থায়ীভাবে মন্ত্রনালয়ে (পুল সিস্টেমের মাধ্যমে) যাওয়ার চেস্টা করে।
- মজার ব্যাপার হচ্ছে এই ক্যাডারের বস (NBR এর চেয়ারম্যান) আসে সাধারণত অ্যাডমিন ক্যাডার থেকে।
- ভবিষ্যতে দেশের বাইরে কিছু নিয়োগ সম্ভব হলেও হতে পারে।
- পুলিশের পর এই ক্যাডারের পাবলিক ইমেজ খারাপ (অনেকের কাছে পুলিশের চেয়েও খারাপ), কারণ অতিমাত্রায় দুর্নীতি, অনেক কাস্টমস ইন্সপেক্টরদেরই (২য় শ্রেণীর কর্মকর্তা) অবৈধ আয় দৈনিক গড়ে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্তও নাকি হয়ে থাকে, এ থেকে এখানে সহকারি কমিশনারদের অবস্থা বুঝে নেয়া যায়।
যাদের শুধু টাকায় মন ভরে না, পাওয়ার প্র্যাকটিসেরও প্রবল ইচ্ছা আছে, তাদের এই ক্যাডারে না আসাই ভাল। যারা চাকুরির বয়স বেশিদিন পাবেন না (যাদের সর্বশেষ বা শেষের আগের বিসিএস) তারা এ ক্যাডার প্রথমেও দিতে পারেন।
★ ট্যাক্স ★
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- এরাও অর্থ মন্ত্রণালয়ের IRD এর একটি ডিভিশন — NBR এর একটি উইং এর হয়ে কাজ করেন।
- লজিস্টিক সুবিধা ভালো তবে শুরুতে (চাকুরির প্রথমদিকে) কাস্টমসের মত নয়।
- প্রমোশন গ্রোথ ভালো তবে কাস্টমসের মত দ্রুত নয়।
- তবে আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে — NBR এর মেম্বার হওয়ার ক্ষেত্রে আবার কাস্টমস ক্যাডারদের তুলনায় ট্যাক্স ক্যাডাররা এগিয়ে থাকে।
- চাকরির প্রথম দিকে ঢাকার বাইরে পোস্টিং বেশি।
- কাজের চাপ সিজনালি কম বা বেশি (সিজন বলতে আয়কর রিটার্ন এর সময়)।
- প্রশাসনিক ক্ষমতা (সাধারণ) অনেক কম, তবে উচ্চ পদে গেলে কর্পোরেট/ব্যবসায়ী লেভেলে অনেক ক্ষমতা আছে।
- বৈধ উপায়ে বেশ টাকা কামানো সম্ভব, আয়কর ফাঁকি ধরতে পারলে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট শতাংশের Grant of Rewards দেয়া হয়।
- অবৈধ উপায়েও আরও অনেক বেশি আয় সম্ভব।
★ ইকোনমিক ★
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- ইকোনমিক ক্যাডারে ফরেন ক্যাডারের পর সবচেয়ে বেশি বাইরে যাওয়ার সুযোগ।
- পুরো চাকুরি জীবন বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে (মেইনলি অর্থ/পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ে ) অর্থাৎ ঢাকায় থাকার সুবিধা।
- বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও ট্রেনিং এর অধিকতর সুযোগ।
- প্রমোশন গ্রোথ মাঝামাঝি (দ্রুত-ও না / ধীর-ও না)।
- ডেপুটেশনে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় (UN, WB, UNESCO, ADB etc.) যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া যায়, (এসব সংস্থা’র বেতন অনেক উচ্চ হয় )।
- এই ক্যাডারে বস আসে অ্যাডমিন ক্যাডার থেকে, কারণ- সর্বোচ্চ পদ ডিভিশনাল চিফ হচ্ছেন অতিঃ সচিব।
★ (অডিট) নিরীক্ষা ও হিসাব ★
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- সরকারি যত হিসাব-নিকাশ ও তদারকির কাজ আছে তা পালন করে থাকেন এই ক্যাডাররা।
- Tax Payers Money ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের Accountability এবং Transparency নিশ্চিত করেন এই ক্যাডাররা।
- কাজের চাপ মোটামুটি।
- প্রমোশন গ্রোথ ভাল।
- ট্রেনিং ও ট্যুর আছে (অভ্যন্তরীণ ও বহিঃ)।
- এই ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ CAG একটি সাংবিধানিক পদ।
- অন্য সব ক্যাডাররাই এই কাডারকে সমীহ করে থাকে, কারণ- অডিট/হিসাব সব প্রতিষ্ঠানেই হয়ে থাকে, অন্য প্রতিষ্ঠানের ভুল-ত্রুটি ধরাই এদের কাজ, এছাড়াও অন্য ক্যাডারদের বেতন/পেনশনের জন্যও তারা অডিট ক্যাডারদের সমীহ করে থাকে।
- সাধারণত ডিভিশনাল শহরগুলোতে পোস্টিং, তবে ঢাকায় পোস্টিং বেশি।
- কোয়ার্টার ও পরিবহন সুবিধা ভালো; উচ্চ পদে গেলে এ সুবিধা অনেক বেশি ভালো।
- রাজনৈতিক প্রভাব তুলনামূলক কম।
★ আনসার ★
সুবিধা-অসুবিধা সমূহ
- কাজের চাপ তুলনামূলক কম।
- লজিস্টিক সুবিধা বেশ ভালো, চাকুরির প্রথম থেকেই গাড়ি সুবিধা পাওয়া যায়, এছাড়া বাসস্থান সুবিধা তো আছেই।
- নিরিবিলি, তুলনামূলক কম ঝামেলা-সম্পন্ন দায়িত্ব।
- সর্বোচ্চ DG পর্যন্ত হওয়া যায়, উপরের দিকে সব প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আর্মি) কর্মকর্তারা দায়িত্বে (বস) থাকেন।
- প্রমোশন গ্রোথ মাঝামাঝি ভালো।
★ খাদ্য, তথ্য, সমবায়, বাণিজ্য, রেলওয়ে, ডাক, পরিবার পরিকল্পনা ★
এই সাধারণ ক্যাডারগুলোর কোনোটিতে উপজেলায় পোস্টিং ও প্রমোশন জনিত সমস্যা রয়েছে। তবে সরকারের এই সেক্টরগুলোতে ভূমিকা রাখতে ক্যাডার চয়েসের তালিকা সাজাতে পারেন আপনার পছন্দমতো।
-ফারহানা ইয়াসমিন
বিসিএস প্রস্তুতির বইগুলো দেখুন