পৃথিবীতে সবাই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে গল্প লিখতে চায়। সবচাইতে শক্তিশালী কিন্তু লেখকরাই, কেননা একজন লেখক চাইলেই মানুষের ভাবনার জগৎটাকে শব্দ দিয়ে আলোড়িত করতে পারেন জীবনের সব অনুষঙ্গে সাজিয়ে, একেকটা চরিত্র চিত্রায়ণের মাধ্যমে। তবে লেখকদের এটাই সবথেকে বেশি মাথায় রাখতে হবে যে একজন পাঠক,কিংবা দর্শকের সবথেকে গভীরে প্রবেশ করতে পারে যা, তা হলো গল্প। আর ঠিক এ কারনেই একজন লেখককে ভালো গল্প পাততে জানতে হবে।গল্পই কিন্তু সব। গল্পই কিন্তু আমাদের এই চারপাশের দুনিয়াকে আরো একটু ভালোভাবে জানতে সাহায্য করতে পারে।
গল্পের শুরুটা যেভাবে হতে পারে-
কেউ একজন অপ্রত্যাশিত কোন সমস্যার সমাধান করবে, এবং সমস্যার মুখোমুখি তাঁকে হতেই হবে, কোনো চেষ্টাতেই এড়ানো সম্ভব না, এবং একটা সময় সমাধান নিয়ে আসবে। পুরো একটা গল্প এমন কিছুর উপরে ভিত্তি করেও হয়ে যেতে পারে একবার লিখতে বসলেই। এবং একটা মস্তিষ্ক সবথেকে উদ্বেলিত হয় কোনো অপ্রত্যাশিত সারপ্রাইজে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। হ্যাঁ, এই যে, এই সারপ্রাইজ ব্যাপারটাই কিন্তু আমাদের কৌতুহল বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। কিছু ঠিক নাই মানেই কেন ঠিক নাই প্রশ্নটা আপনার মাথায় আসবে। মানুষের মস্তিষ্ক অনেকটা এমনই।
কেন লিখছেন গল্প?
গল্প কিন্তু অনেকটা ‘নিড টু নো’ ঘরানার, মানে জানার প্রয়োজনীয়তা থেকেই গল্প। যদি আপনার পাঠক আপনার গল্প শুনতে আগ্রহীই না থাকে, তবে সে গল্প আপনি বলবেন ই বা কেন? তবে ওই আগ্রহটা জন্ম দেবার দায়িত্বটা কিন্তু আপনারই , গল্পের শুরুতেই!
পাঠককেই চরিত্র বানিয়ে নিন-
আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশলটা মাথায় রেখেই লিখুন। প্রথমে পাঠকের মাথায় এটা অন্তত আপনাকে ঢুকিয়ে দিতে হবে যে, গল্পটা কার? গল্পের প্রধান চরিত্রটা আসলে কে? যাতে করে, প্রধান চরিত্র তথা গল্পের হিরো যেমনটা অনুভব করবে, পাঠক ও যেন ঠিক তেমনই অনুভব করে। এবং এরপর প্রধান চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গেই যেন পাঠক সমস্যা সমাধানে নেমে যেতে পারে কিংবা গল্পের পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এভাবেই তো হঠাৎ আপনার চারপাশেই ঘটা বাস্তব জীবন থেকে ঘটা কোনো কাহিনীকে ভিত্তি করে পাতা শুরু করে দিতে পারেন একটা গল্প! এটা মাত্র একরকমের একটা আইডিয়া শেয়ার করা, আপনি অন্য কোনোভাবেও কিন্তু শুরুটা করতেই পারেন!
যে অভ্যাস আবশ্যকীয়
না পড়লে ভালো লেখা যায়না। ফলেই, বেশি বেশি করে পড়ুন এবং চারপাশের সবকিছুই গভীর পর্যবেক্ষণের চোখে দেখার অভ্যাস করুন।
লেখার আগেই পরিষ্কার ধারণা রাখুন!
কী লিখবেন? সাজাবেন কীভাবে?
আপনার পুরো গল্পের মূল সারবস্তুটা আসলে কি হতে যাচ্ছে, এটা যদি আপনি ভালো করে না জানেন, তাহলে থামুন! ভালো করে জানুন এবং এরপর লেখা শুরু করুন। সহজেই লিখতে পারবেন, সময়ও কম লাগবে। এবং সবথেকে ভালো যা হবে এ কারনে, তা হলো, আপনার লেখায় আসতে পারতো অপ্রাসঙ্গিক, এমন অনেক কিছুই আপনি সহজেই বাদ দিয়ে দিতে পারবেন।
একটু পড়ে দেখুন -লেখালেখির ১০১ অনুশীলন
ধীরে ধীরে গল্পের প্রধান চরিত্রের মানসিক চিন্তা-চেতনা , কার্যক্রমকে সামনে নিয়ে আসুন।
আপনার তৈরি করা গল্পের প্রধান চরিত্রের আসলে কাজটা কী? সে চায় কী? তাঁর উদ্দেশ্য কী? এবং সে তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছাতে কী কী বাঁধা অতিক্রম করতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েই পারবেন ধীরে ধীরে সামনে আনতে মানসিক চিন্তা-চেতনা। তবে একজন লেখক হিসেবে সবকিছু চরিত্রের মতো করে চিন্তা করে লেখা কঠিন হলেও প্রধান চরিত্র তথা গল্পের নায়কের অতীতের কোনো ঘটনা বর্ণনা থেকে শুরু করে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এর মিশেলেই কিন্তু খুব সূক্ষ্ম প্রচেষ্টায় আপনার ভাষাগতো জাদুকরী কারিকুরিতেই কিন্তু খুব সুন্দর একটা গল্প পেতে ফেলা সহজ।
কনটেক্সট আর স্পষ্ট পরিস্ফুটনের ভেলকী
মননে মগজে ভিজ্যুয়ালাইজ না করতে পারলে, আমরা সে ব্যাপারটা অনুভবও করতে পারিনা। খুবই গৎবাঁধা সর্বাঙ্গীণ চিন্তায় লেখার থেকে কোনো একটা কিছুকে যদি কন্টেক্সটে ফেলে দিতে পারেন, অর্থাৎ , কোনো ঘটনাক্রম সাজিয়ে বা বাস্তব কোনো ঘটনার সাথে মিশিয়ে পাঠককে আপনার বলতে চাওয়া গল্পটা বলে দিতে পারেন, তবেই তো বাজিমাত! যাতে করে পাঠক নিজেকেই আপনার গল্পে আবিষ্কার করে নিতে পারে।
বিশ্বের বড় বড় কালজয়ী সব গল্পকারদের লেখায় দেখবেন, তাঁদের লেখায় সবকিছুই বর্ণিত থাকে খুবই সুস্পষ্টভাবে। অনেকটা জারনালিস্টিক ভঙ্গীতে। যা ঘটেছে ঠিক সেটাই বলা হচ্ছে। এবং আপনি সেটা অনুভব করতে পারছেন, চোখের সামনে দেখতে পারছেন। আপনি বর্ণনা পড়বেন, শেষ করবেন এবং অজান্তেই আপনাকে ছুঁয়ে যাবে। এমন একজন গল্পকারের নাম গী দ্যা মোপাসা। কিংবা, কোনো শান্তিরক্ষীদের স্মৃতিকথার ফাঁকে ফাঁকে উঠে আসা গল্পের মতো।
এক আর্মি মেজরের গল্প
তিন লাইনের একটা গল্পের শুরু দেখি। “কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর, ডিসেম্বরের শীত, কনকনে ঠান্ডায় আর্মি মেডিকেল কর্পসের সদস্য মেজর বিলাল আর্মি ইউনিফর্মে অস্থায়ী দপ্তরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে, কারন ওখানে একজন সিভিলিয়ান রোগীকে দেখতে হবে দ্রুত”। কল্পনায় ভাসলো নিশ্চয়ই! হ্যাঁ, পাঠকের কল্পনার জগৎটাকেই রাঙ্গিয়ে তুলতে হবে আপনাকে।
গল্পের শেষটা এমন হতে পারে যে, “ মেজর বিলাল সুদানিস ভাষা জানেনা ঠিকই, কিন্তু সেই সিভিলিয়ান মেজর বিলালের উপকার ভোলেননি… বিদায়ের সময় স্নিগ্ধ এক হাসি ফুটে উঠলো সিভিলিয়ানের ঠোঁটের কোণায়”।
আবার ধরুন, ভালোবাসা শব্দটা পড়লেন, এখন কি ভাসছে আপনার চোখে? হ্যাঁ, ভালোবাসা বলতে আপনার যে উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতা , তাই ভেসে উঠেছে নিশ্চয়ই। কন্টেক্সট মিলিয়ে গুছিয়ে ফেলুন আপনার গল্প এখনই, ঠিক আপনি যা বলতে চান…
লেখালেখিতে আগ্রহী লেখকদের জন্য লেখালেখির হাতেখড়ি
একটু পড়ে দেখুন
নিলম্বন (সাস্পেন্স) আর দ্বন্দ্বের ব্যবহার
আপনার গল্পের বাঁকে বাঁকে নিলম্বন আর দ্বন্দ্বের অবতারণা না করলে কিন্তু পাঠক খুব একটা আগ্রহ না দেখিয়ে মনোযোগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে নিতে পারে। তাই বাঁকে বাঁকে সাসপেন্স রাখবেন কিনা সিদ্ধান্ত আপনার!
পাঠক যেন এক বসায় পুরোটাই পায়… একেবারে লেগে থাকে যেন… এবং একই সাথে যে ইতিবাচকতা আপনি ছড়াতে চাইলেন গল্পের মাধ্যমে তা ও যেন পাঠক পরমানন্দে গ্রহণ করে নিতে পারে।
লেখালেখি সংক্রান্ত বইগুলো দেখুন এখানে
কারন এবং প্রভাব
আপনার গল্পে কোন একটা বাঁক নিলো, কিন্তু কেন? কোন বিশেষ ঘটনা ঘটলো, তবে কেন? কারন ব্যাখ্যা করুন, ব্যাখ্যা করুন চরিত্রগুলোর দৈনন্দিন জীবনে ঘটা সে ঘটনার প্রভাব এবং পরিণতিটা।
উদ্দেশ্য কী? স্বার্থ কী?
এই কথা বলে কোন লাভ নাই যে আপনার কোন উদ্দেশ্য নেই। দুনিয়াতে যে ই একবার আসছে, তাঁরই একটা উদ্দেশ্য হয়, লক্ষ্য থাকে, চরিতার্থ করবার মতো স্বার্থ থাকে। আমাদের মস্তিষ্ক যখন থেকেই ধরে নেবে যে কোনো কিছুর কোনো উদ্দেশ্য নেই, ঠিক তখন থেকেই চারপাশের সব অর্থহীন, কোনো কিছুর কোন মানেই নেই। আর ঠিক এ কারনেই আপনার গল্পের প্রধান চরিত্রেরও একটা স্থির লক্ষ থাকতে হবে। এবং কোনো কষ্ট ছাড়াই আপনার গল্পের নায়ক লক্ষ্যে পৌঁছাক কিংবা “বিনা যুদ্ধে নাহি দেবো সূচগ্র মেদিনী” বলে প্রচুর যুদ্ধ-ক্লেষ্ট শেষে লক্ষ্যে পৌঁছাক, লক্ষ্যে পৌঁছাতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন, লক্ষ্যে কি পৌঁছাতেই হবে? সুন্দর পরিণতি কি হতেই হবে?
না, ট্র্যাজিক পরিণতিও হতে পারে। সুন্দরভাবে শেষ না ও হতে পারে। লেখক আপনি! সিদ্ধান্ত আপনার! তবে আপনার গল্পের পাঠককে গুরুত্বপূর্ণ কোন বার্তা দিয়ে শেষ করাই সবথেকে বেশি সমীচীন বৈকি!
ইটস টাইম টু চেক
গল্পের কোথাও কোন ফাঁক-ফোকড় রয়ে গেলো কিনা, অপ্রাসঙ্গিকতা বা ধারাবাহিক ঘটনাক্রমে অসামাঞ্জস্যতা রইলো কিনা , তা এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখুন। এরকম কোথাও পেলে ঠিক করে দিন। এক একটা ঘটনার সঙ্গে বা বিবরণীর সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ সম্পর্ক রইলো কিনা এটা ঠিক করাই গুরুদায়িত্ব
গল্পটা কেমন হওয়া চাই, গল্পটা কেমন হয়ে উঠবে-
একটা শিল্পকলার অঙ্কন (চিত্র) অনেক কিছুই বলে। যেন একটা ছবিই গল্প হয়ে ওঠে। বাস্তবতা আর আবেগের মিশেলেই যেন সবটুকু বলে দেয় , গভীর থেকে গভীরে নিয়ে যায়। আপনার গল্পও কিন্তু এমন হওয়া চাই। সহজ, সরল, সুন্দর, প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা কিন্তু জীবনের বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম।