বুখারি শরিফ : এক অবিস্মরণীয় হাদিস-সংকলন

Untitled

বিশ্বের সকল মুসলিমের জীবনে যে গ্রন্থটির প্রভাব অনস্বীকার্য, সেটি হচ্ছে বুখারি শরিফ। নবম শতাব্দীতে সংকলিত এই গ্রন্থের পরিচিতি কেবল আজকে নয়, প্রতি যুগেই এর সুনাম ও সুখ্যাতি মানুষের মাঝে প্রচলিত ছিল।

৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে (১৯৪ হিজরি) জন্মগ্রহণ করা প্রখ্যাত হাদিসবিদ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল (রহ.)-এর জন্ম ট্রান্সঅক্সিয়ানার প্রসিদ্ধ শহর বুখারায় (বুখারা বর্তমানে পশ্চিম উজবেকিস্তানের বুখারা প্রদেশের রাজধানী শহর)। সেই সূত্রে তার নামের শেষে যুক্ত করা হয় বুখারি। আর তার সংকলিত হাদিসের কিতাবের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি সহিহ বুখারি নামে।

হাদিসের পরিভাষায় বর্ণনাকারীদের মর্যাদার ভিত্তিতে সবচেয়ে উঁচু স্তরের যে হাদিস তাকে আখ্যায়িত করা হয় ‘সহিহ’ বলে। মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারি তার সংকলিত গ্রন্থে কেবল এই পর্যায়ের হাদিস নিয়ে এসেছেন বলে তার সেই কিতাব পরিচিতি পায় ‘আস সহিহুল বুখারি’ বলে। একই সঙ্গে এটি তার হাদিসের জগতে এবং দৈনন্দিন জীবনে গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার কারণ। যদিও এই হাদিস-সংকলনের পূর্ণ নাম হচ্ছে, ‘আল জামেউল মুসনাদুস সহীহ আল মুখতাসারু মিন উমুরি রাসুলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওয়া সুনানিহি ওয়া আইয়্যামিহি।’ প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি সর্বপ্রথম এই নামটি উল্লেখ করেন। সংক্ষেপে গ্রন্থটিকে ‘আল-জামে’ নামে অভিহিত করা হয়।

ইমাম বুখারি মাত্র ষোল বছর বয়সে নিজ শহর বুখারা ছেড়ে ইলমের অন্বেষণে বের হন। মক্কা থেকে সেই ভ্রমণের শুরু হলেও একে একে তিনি হিজরি তৃতীয় শতাব্দীতে অধিষ্ঠিত আব্বাসি খেলাফতের পৃথিবীতে প্রসিদ্ধ সকল জ্ঞানকেন্দ্র ভ্রমণ করেন। হেজাজেই কাটান টানা ছয় বছর, বসরায় গমন করেন চারবার, মিশরে ও সিরিয়ায় দু’বার করে, আর কুফা ও বাগদাদে কত বার ভ্রমণ করেছেন তার কোনও লেখাজোখা নেই৷ এই ভ্রমণের মাঝেই ষোল বছর ধরে মক্কা, মদিনা ও বুখারায় সঙ্কলন করেন ‘আস-সহিহুল বুখারি’। তার সংগ্রহীত হাদিসের মধ্য থেকে সর্বশ্রেষ্ঠগুলো তিনি এখানে নিয়ে এসেছেন৷ তার নিজের বক্তব্য হচ্ছে, এক লক্ষ হাদিস থেকে বাছাই করে আল-জামেতে (বুখারি শরিফে) নিয়ে এসেছেন মাত্র সাত হাজার হাদিস। অবশ্য এই সংখ্যা নিয়ে নানান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আছে।

Mir-e Arab Mosque, Bukhari-বুখারির মসজিদ
মীর-ই-আরব মাদ্রাসা, যেখানে ইমাম বুখারী তার বুখারী শরীফের নুসখা (হস্তলিখিত কপি) লিপিবদ্ধ করিয়েছেন

হাফেজ ইবনুস সালাহের মতে, সহিহ বুখারির হাদিসসংখ্যা ৭২৭৫টি। অনেকগুলো হাদিস তিনি একাধিক অধ্যায়ে এনেছেন, যদি সেই পুনরুল্লেখকে হিসেবে না আনা হয় তাহলে সে সংখ্যা নেমে আসে ৪০০০-এ। আর হাফেজ ইবনে হাজারের গবেষণা বলছে সহিহ বুখারির হাদিসসংখ্যা সর্বমোট ৯০৮২টি। অবশ্য ইবনে হাজারের এই হিসেবে বুখারির মুআল্লাক ও মুতাবাআত (হাদিসের দুটি পরিভাষা) হাদিসসমূহও অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া সহিহ বুখারিতে এমন ষোলটি হাদিস আছে যেগুলোর সনদে ইমাম বুখারি থেকে রাসুলুল্লাহর (সা.) দূরত্ব মাত্র তিনজন বর্ণনাকারীর। প্রায় আড়াইশ’ বছরের কালপরিক্রমায় মাত্র তিনটি স্তরে রাসুল (সা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করা একদিকে যেমন একজন মুহাদ্দিসের সৌভাগ্যের প্রতীক, তেমনি হাদিসের পেছন প্রবল অনুসন্ধিৎসা ও পরিশ্রমের পরিচায়কও বটে।

ইমাম বুখারি তার এই বিরাট সংকলনে বিরল কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। যতগুলো হাদিস এনেছেন তার সকল বর্ণনাকারীর অবস্থা যাচাই করে হাদিসের মানে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই তাদের বর্ণিত হাদিসকে ‘আল-জামে’তে উল্লেখ করেছেন। এই যাচাই বাছাইয়ে দুটি বিষয় লক্ষ্য করতেন, বর্ণনাকারী সঠিক মানে উন্নীত কিনা আর নিশ্চিতভাবে সেই বর্ণনাকারী নিজ কানে শুনেছে কি না। এছাড়া এমন রাবী’র (হাদিস বর্ণনাকারী) হাদিসই তিনি গ্রহণ করতেন যারা তাদের বর্ণিত হাদিসের ওপর আমল করেন৷ এ জন্য কোনও বাতিল ফিরকার (ভ্রান্ত দল) রাবীর বর্ণনা তিনি আল-জামে’তে আনেননি। এ ছাড়া প্রতিটি হাদিস লেখার আগে পাক-পবিত্র হয়ে নিতেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়ে ইস্তেখারা করতেন। তারপর সেই হাদিস প্রকৃতই সহিহের মানে উন্নীত এই দৃঢ়বিশ্বাস জন্মাবার পরই মূলত তিনি তার সংকলনে হাদিসটি অন্তর্ভুক্ত করতেন। কোনও কোনও হাদিস অন্তর্ভুক্ত করার আগে রোজা রাখতেন বলেও বর্ণনা আছে। বিশেষ বিশেষ স্থান, যেমন, কাবা ঘরের সামনে, রাসুলের (সা.) রওজার পাশে (রিয়াজুল জান্নাহ) বসে সহিহুল বুখারির কিছু কিছু অংশ লিখেছেন। এভাবে তার এই সংকলনটি বাস্তবিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে।

এই সতর্কতা ও নিয়মনিষ্ঠার ফলে একদিকে যেমন বুখারি শরিফ ‘প্রথম সহিহ হাদিসের সংকলন’ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে, তেমনি লাভ করেছে হাদিসশাস্ত্রবিদদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও প্রশংসা। ইমাম বুখারির যুগের হাদিস বিশারদ গ্রন্থটি সম্পর্কে বলেন, ‘এটি আল্লাহর কিতাবের (কোরআন) পর সবচেয়ে বিশুদ্ধ কিতাব।’ এমনকি স্বয়ং সংকলক ইমাম বুখারি সম্পর্কে হাফেজ ইবনে হাজার আসকালান লেখেন, ইমাম বুখারির এত প্রশংসা করা হয়েছে যা লিখতে গেলে কাগজ-কালি ফুরিয়ে যাবে।

যে-কোনও কিতাবের গ্রহণযোগ্যতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে এর ব্যাখ্যাগ্রন্থ তৈরি হওয়া। বুখারি শরিফের অসংখ্য গ্রহণযোগ্য ও বৃহৎ কলেবরের ব্যাখ্যাগ্রন্থ যুগের পর যুগ ধরে লিখিত হচ্ছে। তার মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হচ্ছে :

১. ই’লামুস সুনান, লেখক: আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ আল খাত্তাবী (মৃত্যু ৩২৮ হিজরী)। এটি সর্বপ্রথম লিখিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ।
২. শারহুল বুখারি, লেখক: আবুল হাসান আলী ইবনে খালফুল গারবী (মৃত্যু ৪৪৯ হিজরি)।
৩. শারহুল বুখারি, লেখক: ফখরুল ইসলাম আলী মুহাম্মাদ আয যাদুবি (মৃত্যু ৪৮২ হিজরি)।
৪. শারহুল বুখারি, লেখক: আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনুল আরাবী (মৃত্যু ৪৪৯ হিজরি)।
৫. ফাতহুল বারী, লেখক: হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী (মৃত্যু ৮২৮ হিজরি)।
৬. উমদাতুল কারী, লেখক: হাফেজ বদরুদ্দীন আইনি (মৃত্যু ৮৫৫ হিজরি)।

এছাড়া আরো অসংখ্য ব্যাখ্যাগ্রন্থ রয়েছে, যা যুগে যুগে পাঠককে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে বুখারি শরিফের হাদিসের পাঠ বুঝতে সাহায্য করেছে।

ইমাম বুখারির (রহ.) এই হাদিস সংকলনের উদ্দেশ্য ছিল প্রধানত সহিহ হাদিসসমূহকে আলাদা করে একত্র করা। হিজরি তৃতীয় শতকের আগের যেসব হাদিসের সংকলন পাওয়া যায় সেগুলোতে সব পর্যায়ের হাদিস পাওয়া যেত। তখনকার মুহাদ্দিসদের লক্ষ্য ছিল সব রকম হাদিস আগে জমা হয়ে যাক, বিশুদ্ধ, দুর্বল, জাল যা-ই হোক না কেন। পরবর্তী সময়ে শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করে তা আলাদা করা যাবে। ইমাম বুখারির সময়ে এসে সেই প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হওয়ায় তিনি এ-কাজে হাত দেন। তাঁর শিক্ষকগণও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেন৷

অবশ্য সহিহ হাদিস একত্র করা ছাড়াও বুখারি সংকলনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, হাদিস থেকে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান নির্ণয় করা। এই উদ্দেশ্যের ফলে তিনি অসংখ্য বিষয়-শিরোনাম নির্ধারণ করে তার অধীনে হাদিস বসিয়েছেন। একেকটি শিরোনাম ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ ও সমস্যার দিকে আলোকপাত করেছে, আর তার সমাধান হিসেবে তিনি উপযুক্ত হাদিস উল্লেখ করেছেন। এই শিরোনামই গ্রন্থটির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য। এ জন্য দেখা যায়, প্রাসঙ্গিক হওয়ায় একই হাদিস ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা প্রসঙ্গে উল্লেখ করছেন।

সেকালে ছাপাখানা না-থাকায় গুরুত্বপূর্ণ কোনও বই কারো প্রয়োজন হলে মূল শিক্ষক কিংবা সেই কিতাবের উস্তাদের সান্নিধ্যে গিয়ে লিখে আনতেন৷ কখনও একবার লিখিয়ে নিয়ে কয়েকবছর পর আবার পরিমার্জনের জন্য তার কাছে গিয়ে অবস্থান করতেন। এটিকে বলা হয় ‘নুসখা’ (লিপিবদ্ধ কপি) তৈরি করা৷ এই নুসখা ছাত্রের ছাত্রত্বের প্রমাণও বটে। ইমাম বুখারি তার গ্রন্থ বুখারি শরিফ ৯০ হাজারের বেশি ছাত্রকে পড়িয়েছেন বলে এর নুসখা-সংখ্যাও বহু। আল্লামা তাকি উসমানি বুখারা সফর করে এসে বলেছেন, সেখানে একটি মাদরাসা আছে ‘মীরে আরব’ নামে, আজও বিদ্যমান রয়েছে। সে-মাদরাসায় ইমাম বুখারি তার গ্রন্থের নুসখা লিপিবদ্ধ করিয়েছেন।

এর মধ্যে চারজনের নুসখা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।

১. নাসাফি
২. বাযদবি
৩.হাম্মাদ ইবনে শাকের
৪. আল-ফেরাবরি

এঁদের মধ্যে ফেরাবরির (২৩১-৩১০ হিজরি) নুসখা সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয়৷ ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত নুসখাগুলো ফেরাবরির। যা তিনি ইমাম বুখারির কাছ থেকে শুনে এবং তাকে দুবার শুনিয়ে লিখে নিয়েছেন। প্রাচ্যবিদ মানজানা বলেন, বুখারি শরিফের হাতে লেখা সবচেয়ে পুরাতন নুসখা যেটি পাওয়া গেছে, তা ৩৭০ হিজরি মোতাবেক ৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত। সেই নুসখাটি আল মিরওয়াজির সূত্রে ফেরাবরি বর্ণিত। আর সবচেয়ে পুরাতন ছাপা কপিটি হচ্ছে ইসাম কৃত। যা তুরস্কে ৫৫০ হিজরি মোতাবেক ১১৫০ খৃষ্টাব্দে ছাপা হয়েছিল৷

এমন বিখ্যাত যে হাদিস বিশারদ এবং এত বিখ্যাত যার গ্রন্থ তিনিও যুগের শাসকবর্গের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে পারেননি। সমসাময়িক পণ্ডিতদের সঙ্গে জ্ঞানগত মতবিরোধ তো আছেই, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বুখারার শাসক খালেদ ইবনে আহমদ জুহলির দুর্ব্যবহার। ইমাম বুখারি ছিলেন ইলমের মর্যাদা সম্পর্কে সদা সজাগ সতর্ক মানুষ। ক্ষমতার সামনে ইলমের মর্যাদা বিলিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় শেষ জীবনে বুখারায় ফিরে যে হাদিসের দরস (পঠন-পাঠন) তিনি শুরু করেছিলেন তা বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ এমনকি তিনি জন্মস্থান বুখারা ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী শহর সমরকন্দের দিকে যেতে বাধ্য হন৷ অবশ্য সে শহরে পৌঁছার আগেই খরতঙ্গ নামক স্থানে অবস্থান করেন। ২৫৬ হিজরির ০১ শাওয়াল সেখানেই এই মহামনীষীর ইন্তেকাল হয়।

graveyard of Imam Bukhari- বুখারির সমাধি
সমরকন্দে ইমাম বুখারীর সমাধি

ক্ষণজন্মা মানুষ পৃথিবীতে মহাকালের বিচারে সামান্য কয়েকটি বছর কাটিয়ে গেলেও যাদের তৌফিক হয় তারা এমন কর্ম পেছনে রেখে যান, যা যুগ যুগ ধরে মানবজাতির উপকারে আসে। ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বুখারি ছিলেন তেমনই এক মানুষ, আর তার সেই অবিস্মরণীয় কাজ হচ্ছে ‘আল-জামে আস-সহিহ আল-বুখারি’।

সকল বুখারি শরীফ দেখুন একসাথে


*লিখেছেনঃ মাহমুদ আব্দুল্লাহ 

Tashmin Nur

Tashmin Nur

লিখতে ভালোবাসি, কারণ- আমি উড়তে ভালোবাসি। একমাত্র লিখতে গেলেই আসমানে পাখা মেলা যায়। আমার জন্ম কোথায়, পূর্ণ নাম কী, কোথায় কিসে পড়াশোনা করেছি, এটুকু আমার পরিচয় নয়। যেটুকু আমাকে দেখা যায় না, সেটুকুই আমার পরিচয়। বাকিটুকু আমার চিন্তায় ও সৃষ্টিকর্মে।

2 thoughts on “বুখারি শরিফ : এক অবিস্মরণীয় হাদিস-সংকলন”

  1. দারুন লেখা। বুখারি শরিফ সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। লেখককে ধন্যবাদ!

    1. আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ, সময় নিয়ে পড়ার জন্য। ইসলাম বিষয়ক অন্যান্য লেখাগুলো দেখতে চাইলে এই লিঙ্ক থেকে দেখতে পারেনঃ https://blog.rokomari.com/islam/

Leave a Comment

সম্পর্কিত ব্লগগুলো পড়ুন

Rokomari-blog-Logo.png
Join our mailing list and get the latest updates
Loading