মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অনেকের মাঝেই গণিতভীতি প্রকট। অংকের নাম শুনলেই অনেকের তো হাত পা গুটিয়ে চলে যায় পেটের মধ্যে। কিন্তু তোমরা কি জানো, অংকের এই ভয়কে তোমরা অনেক সহজেই জয় করে ফেলতে পার?
অংকের এই ধাঁধাকে জয় করতে হলে তোমাকে প্রথমেই বুঝতে হবে, এই বিষয়টি অন্য সব বিষয়ের মত নয়। তুমি যেভাবে বাংলা পড়, যেভাবে ইংরেজি পড়, যদি সেভাবেই গণিত করার চেষ্টা কর- তাহলে কিন্তু তোমার সমস্যাটার সমাধান হবে না। গণিতে ভাল করতে হলে তোমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করতে হবে। তাহলে গণিতে ভাল করতে হলে তোমাকে কী কী করতে হবে?
১। তোমার গণিতভীতির ধরণটাকে বুঝতে শেখ
গণিতের সংখ্যা এবং অংক দেখলেই যদি তোমার ভয় লাগে, তাহলে তোমার মধ্যে গণিতভীতি আছে। প্রথমেই এই ভীতিটাকে মেনে নিতে হবে, এরপর ভীতিটাকে দূর করা যাবে। কোনো একটি সমস্যা সমাধানের প্রথম সূত্রই হল সমস্যাটাকে মেনে নিতে শেখা। এরপর তোমাকে বুঝতে হবে, তোমার এই ভীতিটা আসলে কী ধরনের?
এক, হতে পারে তুমি আসলে গণিতকে ভয় পাও না। তুমি ভয় পাও গণিতের পরিখা, কুইজ আর হোমওয়ার্ককে।
দুই, হতে পারে তোমার মধ্যে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এই পৃথিবীতে তুমিই একমাত্র মানুষ যে কিনা গণিতকে ভয় পায়, আর বাকি সবাই-ই তোমার চাইতে ভালো!
তিন, হতে পারে তুমি নিজেকে এতটা আনস্মার্ট ভাবতে শুরু করেছ, যাতে করে তুমি গণিত অনুশীলন করাই ছেড়ে দিয়েছ।
চার, হতে পারে গণিতে তুমি আসলে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছ।
এই চারটি সমস্যার মধ্যে তোমার সমস্যা কোথায়? একটি-দুইটিতে, নাকি সবকটিতেই? সেটা বুঝে সমস্যা সমাধান করাটা জরুরি।
২। পরনির্ভরশীলতা কাটানো
বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সমস্যাটি প্রকট। এই একটি সমস্যার কারণেই বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা গণিতভীতিতে ভুগছে। সমস্যাটা আসলে আমাদের গণিতের সংস্কৃতিতে। খুব ছোট একটা বয়স থেকে আমাদের যেভাবে গণিতে শেখানো হয় সেটা মোটেও আদর্শ কোনো পন্থা নয়।
আমাদের বইগুলোতে একেকটা অধ্যায়ের শেষে এক বা একাধিক অনুশীলনী সংযুক্ত থাকে। আমাদের বেশিরভাগ গণিতশিক্ষক যেটা করেন – এই অনুশীলনী থেকেই গণিতটাকে করা শুরু করেন। তোমরা নিজেরাই হয়তো মনে করতে পার, হঠাৎ করেই একদিন তোমাদের গণিত শিক্ষক এসে ব্লাকবোর্ডে লিখে বসে আছেন-
“অনুশীলনী ৩.১, ৪(১)”
এটা আসলে গণিত শেখার আদর্শ কোন পন্থা নয়। কেউ যখন কাউকে গণিতের সমস্যাগুলিও সমাধান করিয়ে দেয়, তখনই আসলে গণিত শেখার প্রথম সর্বনাশ টা হয়ে যায়। তাই তোমাকে এই পরনির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠতে হবে।
গণিতের সমস্যাগুলি নিজেকেই সমাধান করতে হবে। শেখার মধ্যে তুমি যেটা করবে তা হল, বইয়ের অনুশীলনী শুরুর আগে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা আর ছবি আঁকা থাকে। এসব জ্ঞানগর্ভ কথাকে বলা হয় গণিতের থিওরেম।
এই থিওরেমটাকে তোমায় ভালভাবে বুঝতে হবে। এই বোঝার প্রক্রিয়া তুমি তোমার শিক্ষকের থেকেও পেতে পার, অথবা ইন্টারনেটের এই যুগে তুমি ‘অন্যরকম পাঠশালা’র মত লার্নিং প্লাটফর্ম থেকেও শিখতে পার। কিন্তু এই থিওরেম অংশটুকু বাদ দিয়ে সোজা অনুশীলনীতে চলে গেলে তুমি আর গণিত শিখবে না, তুমি শিখবে ‘কিভাবে গণিত করতে হয়’।
৩। নিজের ভুল মেনে নেওয়া
গণিতে ভীতির সবচেয়ে বড় ভিত্তি হল আমরা ভুল করতে ভয় পাই। আমরা যখন কোন গণিত করা শুরু করি, তখন আমরা এটা ভেবে ভয় পাই যে আমার এই প্রক্রিয়াতে হয়তো অংকটা মিলবে না। তখন আমরা অংক করার শুরু থেকেই একটা সমাধান আনার চেষ্টা করি আর ব্যার্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিই। অথচ এটাও কিন্তু গণিতের আদর্শ পন্থা নয়।
গণিতে ভুল হবেই; আর এটা মেনেই নিতে হবে। ‘মিলেনিয়াম প্রাইজ প্রবলেম’ লিখে গুগল করলেই দেখবে গণিতের সাতটি বিখ্যাত সমস্যা আছে, যেগুলি এখন পর্যন্ত কেউ সমাধান করতে পারেনি। তাই বলে গণিতবিদেরা কি এর সমাধানের চেষ্টা থেকে বিরত আছে? না কিন্তু! তারা এর সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে, হয়তো পারছে না তাই বলে পিছু হটছে না।
তোমাকেও যে কোনো গণিতের সমস্যার ক্ষেত্রে এটাই করতে হবে। কোনোভাবেই পিছু হটা যাবে না, গণিতের সমস্যাটাকে মেলানোর চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রথমেই হয়তো তোমার এই সমস্যাটির সমাধান নাও হতে পারে, কিন্তু হাল ছাড়লে চলবে না। প্রথম লাইন, এরপর দ্বিতীয় লাইন, এভাবে একেক লাইন করে আগাতে হবে।
গণিতের কোন শর্টকাট নেই, যেখানে একদম প্রথম লাইন থেকেই তুমি সমস্যাকে সমাধান করবে।
৪। নিয়মিত অনুশীলন
এটা নিয়ে তো বেশি কিছু বলার নেই। গণিতের নিয়মিত অনুশীলন ছাড়া গণিতে ভাল করা অসম্ভব। গণিতে ভাল করার বা গণিতভীতি কাটানোর উপায়গুলি শুধু জেনে রাখলেই হবে না, বরং এই উপায়গুলির চর্চা চালিয়ে যেতে হবে নিয়মিত। অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় গণিতে সময় দিতে হবে বেশি। প্রত্যেকটা দিনই গণিতের সংস্পর্শে থাকতে হবে।
৫। বাস্তব জীবনের প্রয়োগ
গণিতকে কয়েকটি সংখ্যা ভেবে রাখলে কিন্তু ভুল হবে। গণিত হল একটা ভাষা। আমরা বাস্তবিক জীবনে যা যা দেখি, সেগুলির সংখ্যার ভাষা হল গণিত। গণিতকে তাই শুধু সংখ্যার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখলে গণিত শেখার মূল মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
যেমন ধরো, যখন তুমি অন্তরীকরণের চ্যাপ্টারটা অনুশীলন করো, তখন তুমি একেকটা ফাংশনের অন্তরীকরণ করতে শেখ। আসলে কিন্তু এটাই অন্তরীকরণ নয়। এই যে রাস্তাঘাটে বস্তুর গতি বাড়ছে-কমছে, একটা গ্যাস বেলুনকে আকাশে উড়িয়ে দিলে সেটার বাতাস আস্তে আস্তে কমতে থাকে আর এটার উচ্চতা বৃদ্ধির হারও কমতে থাকে- এটাও কিন্তু অন্তরীকরণের ফল। আবার ছোটবেলায় শেখা বর্গের সূত্রের মাঝেও যে ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের চমৎকার কৌশল লুকায়িত আছে, সেটাও কিন্তু তোমায় শিখতে হবে ।
তাই যদি তুমি গণিতে সত্যি সত্যিই দক্ষ হতে চাও, গণিতের নিউমেরিক্যাল ভ্যালুগুলির এই বাস্তব জীবনের উদাহরণ শেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
৬। প্রশ্ন করতে শেখা
আমেরিকার ‘ইন্সটিটিউট অফ কিউলিনারি এডুকেশন’-এর সাবেক প্রশিক্ষক অ্যানি বারেলের একটি উক্তি মনে করিয়ে দিই। উনি বলেছিলেন,
“সফল হবার একটা অংশ হল প্রশ্ন করা আর সেই প্রশ্নগুলির উত্তর জানা”
কথাটা কিন্তু সত্যি। যদি তুমি শুধু ‘কেন’ জিজ্ঞেস করতে পার- তাহলেই অনেকগুলি শেখার দ্বার তোমার সামনে উন্মুক্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে মাধ্যাকর্ষণের মত বিখ্যাত থিওরেমের আবিষ্কার হয়েছিল এই ‘কেন’র মাধ্যমে। কোপার্নিকাসের গ্রহ-উপগ্রহের ঘূর্ণনের তত্ত্ব আবিষ্কার হয়েছিল এই ‘কেন’র মাধ্যমে। আমরা যে আজ বিজ্ঞানের এত সুফল ভোগ করছি, তার কারণ কিছু বিজ্ঞানী ‘কেন’ জিজ্ঞেস করতে শিখেছিল।
তোমাকেও গণিতে সেটাই করতে হবে। যেকোনো কিছু করার আগে, যেকোনো লাইন লেখার আগে, কেন লিখছ সেটা জানতে হবে। শুধু প্রশ্ন করতে জানলে, কৌতুহল মেটাতে জানলেই তুমি অনেক অনেক কিছু শিখতে পারবে।
সামনেই এইচএসসির উচ্চতর গণিত পরীক্ষা…
গণিতের ভয় তাড়ানোর উপায় তো জানা হল, এ পর্যায়ে পরীক্ষার পূর্ব রাত্রির কিছু টিপস তোমাদের সাথে শেয়ার করছি।
১/ ক্যালকুলাসের অংশটুকু বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে দেখে যাবে। ক্যালকুলাসের দুটি অধ্যায় যদি তুমি ভালোভাবে চর্চা করে থাকো, তাহলে শুধু এইচএসসিই না, এডমিশনের সময়ের জন্যেও তুমি এগিয়ে থাকবে। অন্তরীকরণের ক্ষেত্রে শেষের তিনটি অনুশীলনীতে বেশি গুরুত্ব দেবে। অন্তরীকরণের বেশিরভাগ সৃজনশীল প্রশ্ন এখান থেকেই করে থাকে। যোগজীকরণ থেকে ‘আংশিক ভগ্নাংশ’ এবং ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের অংশের ওপর জোর দেবে। সৃজনশীল এখান থেকেই বেশি এসে থাকে।
২/ ১ম এবং ২য় পত্রের পরীক্ষার জন্যে আলাদা আলাদাভাবে অনুশীলন করাটা জরুরি। ঢালাওভাবে সব অধ্যায় অনুশীলনের চাইতে প্রশ্ন বুঝে অনুশীলন করতে হবে। যেমন ধরো, দ্বিতীয় পত্রে ‘কণিক’ এবং ‘বিপরীত ত্রিকোণমিতি’ অধ্যায় থেকে দুটি প্রশ্ন নিশ্চিত পাবে। তাই এ দুটি অধ্যায় যদি তুমি ভালোভাবে দেখে যেতে পারো, তাহলে গণিত দ্বিতীয় পত্রের সৃজনশীল অংশে দুই সেট প্রশ্নের নিশ্চয়তা পাচ্ছ তুমি।
৩/ এমসিকিউ- এর ক্ষেত্রে যেসব প্রশ্ন অনেক জটিল সেসব প্রশ্ন কখনোই শুরুতে করতে যাবে না। শেষের সময়ে জটিল প্রশ্নগুলির উত্তর করার চেষ্টা করবে। এমসিকিউয়ের ক্ষেত্রে দ্রুত ক্যালকুলেটর চালানো আর ক্যালকুলেটরের ওপর দক্ষতা থাকাটা জরুরি। আর অবশ্যই ক্যালকুলেটর ‘ডিগ্রি’ আর ‘রেডিয়ান’ এর মধ্যে কোন মোডে আছে তা যাচাই করে নেবে।
৪/ ‘ম্যাট্রিক্স ও নির্ণায়ক’ অধ্যায় থেকে ইনভার্স ম্যাট্রিক্স এবং ম্যাট্রিক্সের গুণন টপিকের সমস্যা অনুশীলন করা জরুরী। নির্ণায়কের প্রমাণ নিয়ে অনেকে অনেক বেশি মাথা ঘামায়, কিন্তু এটা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোই শ্রেয়।
৬/ স্থানাঙ্ক জ্যামিতির মধ্যে সরলরেখা অধ্যায়ের ‘লম্ব দূরত্ব’ এবং ‘সমদ্বিখন্ডকের সমীকরণ’ টপিক দুটো থেকে অতীতে বহুবার প্রশ্ন এসেছে। এই দুটি টপিক গুরুত্ব দিয়ে দেখে যাবে। ‘বৃত্ত’ অধ্যায়ের ক্ষেত্রে ‘স্পর্শকের সমীকরণ’, ‘দুটি বৃত্তের ছেদ’-এর থিওরি ভালোমত বোঝা জরুরি। বৃত্তের বেসিক কন্সেপ্ট থেকেও অনেক প্রশ্ন আসে। যারা বৃত্তের বেসিক ধারণা পারো, তারা তো প্রশ্ন দেখেই কেন্দ্র আর ব্যাসার্ধ নির্ণয় করে ফেলতে পারো, যারা পারো না তারা গ্রাফের সাহায্য নিতে পারো।
৭/ তোমাদের হাতে যেহেতু বেশি সময় নেই, তাই বইয়ের প্রতিটি সমস্যা এখন ধরে ধরে রিভিশন করাটা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে যে বইটি তুমি ইন্টারমিডিয়েটের শুরু থেকে অনুশীলন করেছ, সেই বইটির যে যে অংকগুলি বেশিসংখ্যকবার বোর্ড পরীক্ষার এসেছে সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে দেখে যাও।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে যারা নটরডেম কিংবা হলিক্রসের মতো কলেজগুলোতে ভর্তি হতে চাচ্ছো, তাদের জন্যেও গণিতভীতি কাটাতে এই লেখাটি উপকারী হতে পারে।
তোমাদের জন্য আরও পরামর্শ আছে এখানে- কলেজ ভর্তি প্রস্তুতি – মিথ বনাম বাস্তবতা
*তোমার গণিত শেখার পদ্ধতি কী? মন্তব্যের ঘরে আমাদের জানাও। এই ব্লগটি শেয়ার করে সবাইকে দেখার সুযোগ করে দাও।