ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের আগে ৫টি বিষয় নিশ্চিত হয়ে নিন

২০২২ সাল থেকে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলে গুরুত্বপূর্ণ সব পরিবর্তন
tax return

আপনি কি ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করতে যাচ্ছেন? কিন্তু আয়কর অফিসে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলের পূর্বে আপনি কি নিশ্চিত যে সবকিছু ঠিকমত হয়েছে? কোন কিছু বাদ পড়েনি?

নভেম্বর মাস জুড়েই আয়কর মেলা চলবে। এখন সারা মাস ধরেই আয়কর অফিসে আয়কর বিবরণী দাখিল করা যাবে। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত জরিমানা ছাড়া ব্যক্তি করদাতা রিটার্ন জমা দিতে পারবেন। কিন্তু তার আগে আয়কর রিটার্ন তৈরি নির্ভুল হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। কারণ- কিছু বাদ পড়লে বা ভুল হলে পরবর্তীতে সমস্যা হতে পারে। তাই রিটার্ন দাখিল করার আগে নিচের ৫টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিশ্চিত হয়ে নিন।

করযোগ্য আয় গণনা ঠিক আছে?

করযোগ্য আয় গণনা দিয়েই শুরু হয় আয়কর রিটার্ন তৈরির কাজ। প্রথম ধাপেই আপনি যখন সারা বছরের আয় থেকে অব্যাহতি বাদ দিয়ে করযোগ্য আয় বের করবেন তখন লক্ষ্য রাখুন, আয়কর আইন অনুযায়ী আপনি অব্যাহতির সীমা বাদ দিয়েছেন কিনা। খুবই সতর্ক থাকতে হবে করযোগ্য আয় গণনার সময়। কারণ, করযোগ্য আয়ের পরিমাণ যদি বেশি হয়, তাহলে আপনার করের পরিমাণ বেড়ে যাবে। আর যদি করযোগ্য আয় কম হয়, তাহলে ভবিসষ্যতে ফাইল অডিটে পড়লে কর কম দেওয়ার কারণে আইন অনুযায়ী জরিমানা হতে পারে।

তাই আপনার করযোগ্য আয় হতে হবে সঠিক। এজন্য আপনি আগেই নিশ্চিত হয়ে নিন, সারা বছর ধরে কোন কোন উৎস থেকে আয় হয়েছে এবং ঐ আয়ের বিপরীতে আপনার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে কিনা। কারণ, রিটার্ন দাখিলের সাথে আপনার আয়ের সপক্ষে কাগজ জমা দিতে হবে। আপনার করযোগ্য আয়ের পরেই আসে করদায় থেকে কর রেয়াত বাদ দেওয়ার বিষয়টি। কিন্তু কর রেয়াত পাওয়া যায় বিনিয়োগ ভাতার উপর।

সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ভাতা হিসেব করেছেন?

ব্যক্তি করদাতার করদায় কমানোর আইনগত উপায় হলো কর রেয়াত। একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত করদাতা বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে দাবী করতে পারেন, যার উপর নির্দিষ্ট হারে কর রেয়াত পেয়ে থাকেন। এবং এই কর রেয়াত পরে করদায় থেকে বাদ দিয়ে নীট করদায় যা থাকে তা রিটার্নের সাথে জমা দিতে হয়। যেহেতু বিনিয়োগ ভাতার উপর এই কর রেয়াত সুবিধা পাওয়া যায়, তাই আপনি সম্পূর্ণ বিনিয়োগ ভাতা দাবী করেছেন কিনা তা নিশ্চিত হয়ে নিন।

ব্যক্তি করদাতা আয়কর আইনে উল্লেখিত খাতে যদি বিনিয়োগ বা দান করেন, তাহলে ঐ বিনিয়োগ বা দানকৃত টাকা বিনিয়োগ ভাতা হিসেবে দাবী করতে পারেন। তাই আপনি বিনিয়োগ ভাতা নির্ণয়ের সময় লক্ষ্য রাখুন, আপনি যে বিনিয়োগ বা দান করেছেন তা দেখিয়েছেন কিনা। এবং আপনার দাবীকৃত বিনিয়োগ বা দানের বিপরীতে কাজগপত্র আছে কিনা। কারণ, বিনিয়োগ বা দানের সপক্ষে আপনাকে রিটার্নের সাথে প্রমাণ হিসেবে কাগজ জমা দিতে হবে। যেমন- আপনার যদি ডিপিএস থাকে তহলে ব্যাংক থেকে জুন-জুলাই ডিপিএস এর বিবরণী সংগ্রহ করে রিটার্নের সাথে জমা দিয়ে দিবেন।

প্রথম ধাপে আপনি আয় থেকে করযোগ্য আয় গণনার পর কর হার ব্যবহার করে মোট করদায় বের করেছেন। তারপর উপরে বর্ণিত বিনিয়োগ ভাতার উপর কর রেয়াত নির্ণয় করে তাও বাদ দিয়েছেন। এভাবে আপনি নীট করদায় পেয়েছেন। এই নীট করদায় থেকে আপনার কাছ থেকে যদি কোথাও উৎসে কর কর্তন করে রাখা হয়, তাহলে তা বাদ দিতে হবে।

উৎসে কর কর্তন বাদ দিয়েছেন?

আমাদের আয় থেকে আইন অনুযায়ী প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন করে রাখা হয়। যেমন- আপনি যদি চাকরিজীবী হয়ে থাকেন, তাহলে প্রতি মাসে আপনি যে বেতন পাচ্ছেন তা থেকে আপনার প্রতিষ্ঠান একটি নির্দিষ্ট অংক কর্তন করে বাকি টাকা আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে। আপনি আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগেই আয়ের উপর কর দিয়ে দিচ্ছেন। তাই বছর শেষে যখন রিটার্ন দাখিল করবেন, তখন ঐ কর্তনকৃত কর বাদ দিয়ে দেখাবেন।

তবে এক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে, আপনি আয়কর বিবরণীতে যতো টাকা উৎসে কর কর্তন বা অগ্রিম কর দাবী করছেন, তার চালান আপনার কাছে আছে। কারণ, চালান ছাড়া আপনি উৎসে কর বাদ দিতে পারবেন না। তাই যেখানে আপনার আয় থেকে উৎসে কর কর্তন করে রাখা হয়েছে, সেখান থেকে আপনি অবশ্যই চালানের কপি সংগ্রহ করুন। এবং এই চালানের কপি ট্যাক্স রিটার্নের সাথে সংযুক্ত করে দিন।

পূর্বের বছরের অতিরিক্ত কর সমন্বয় করেছেন?

কিছু সময় দেখা যায়, উৎসে কর কর্তন বা অগ্রিম করের পরিমাণ নীট করদায় থেকে বেশি। অর্থাৎ, আপনার করযোগ্য আয়ের উপর যে কর এসেছে, তা থেকে আপনি বেশি কর ইতোমধ্যেই দিয়ে দিয়েছেন। তখন আপনার এই অতিরিক্ত কর পরের বছর সমন্বয় করতে পারবেন।

এক্ষেত্রে আপনি আগের বছরের ট্যাক্স রিটার্ন দেখে নিশ্চিত হয়ে নিন গত বছর বা আগের বছরগুলোতে মোট কতো টাকা আপনি অতিরিক্ত কর দিয়েছেন। তা জেনে নিয়ে আপনার করদায় থেকে বাদ দিন। এরফলে আপনার করের পরিমাণ কমবে।

আয়ের বিবরণ এবং তা থেকে করের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হলো ব্যক্তি করদাতার সম্পদ এবং দায়ের পরিমাণ উল্লেখ করতে হয়।

সম্পদ এবং দায় পূর্ণাঙ্গ দেখিয়েছেন?

প্রথমেই নিশ্চিত হয়ে নিন পরিসম্পদ, দায় ও ব্যয় বিবরণী আপনার জন্য বাধ্যতামূলক কিনা। কারণ, সকল করদাতার জন্য এই বিবরণী বাধতামূলক না। কিছু নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ হলেই কেবল একজন ব্যক্তি করদাতাকে সম্পদ ও দায়ের বিবরণী রিটার্ন ফরমের সাথে সংযুক্ত করতে হয়। তবে আপনি চাইলে স্বপ্রণোদিতভাবে জমা দিতে পারেন। যেহেতু এই বিবরণী বাধ্যতামূলক না এবং পূরণ করা জটিল, তাই না দেওয়াই ভালো।

যদি বাধ্যতামূলক হয় তাহলে গত বছরের আয়কর বিবরণী দেখে দেখে আপনার সম্পদ এবং দায় পূরণ করে নিন। সাথে সাথে যদি কোন সম্পদ বা দায় বৃদ্ধি পায়, তাহলে আগের বছরের অংকের সাথে যোগ করে দেখাবেন। আর যদি হ্রাস পায়, তাহলে গত বছরের অংক থেকে বিয়োগ করে দেখাবেন।

সম্পদ এবং দায়ের তথ্য উল্লেখ করার সময় কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য রাখুন। আপনার ব্যাংক-ব্যালেন্স ব্যাংক বিবরণীর সাথে মিলিয়ে নিন। যদি ব্যাংক লোন থাকে তাহলে ৩০ জুন ২০২২ তারিখে ব্যাংক থেকে যে লোন স্টেটমেন্ট নিয়েছেন তার সাথে মিলিয়ে দেখুন। এবং নগদ টাকার পরিমাণ বাস্তবে আপনার কাছে যতো থাকে ততোই উল্লেখ করুন। বেশি দেখালে বরং ঝামেলা বাড়বে।

এভাবে উপরের বিষয়গুলো যখন আপনি নিশ্চিত হয়ে যাবেন, তখন আপনি আয়কর অফিসে রিটার্ন দাখিল করার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে তার আগে আপনি রিটার্ন তৈরি করার সময় যে কাগজপত্রের সাহায্য নিয়েছেন তা রিটার্নের সাথে জমা দিয়ে দিন। এবং অবশ্যই পূরণকৃত রিটার্ন ফরম এবং তার সাথে সংযুক্ত সকল কাগজপত্রের এক সেট ফটোকপি করে রাখুন।

উপরে হয়তো লক্ষ্য করেছেন, রিটার্ন তৈরির সময় প্রায়ই বিগত বছরের রিটার্নের কথা উল্লেখ করেছি। এই বছর যেমন ট্যাক্স রিটার্ন তৈরি করতে গত বছরের কিছু তথ্য দরকার পড়েছে, তেমনি আপনি আগামী বছর যখন আবার রিটার্ন তৈরি করবেন তখন এই বছরের রিটার্ন প্রয়োজন পড়বে।

এছাড়াও যদি ভবিষ্যতে কোনো সময় ট্যাক্স ফাইল অডিটে পড়ে, তাহলে এই সংরক্ষণ করে রাখা ফাইল দেখে মনে করতে পারবেন, আপনি ট্যাক্স রিটার্নে কী উল্লেখ করেছিলেন। তাই অবশ্যই ট্যাক্স রিটার্নের ফটোকপি সংরক্ষণ করুন।

-জসীম উদ্দিন রাসেল

কর পরামর্শক এবং প্রশিক্ষক, ট্যাক্সপার্ট

আরও পড়ুনট্যাক্স রিটার্ন ২০২২ : জেনে নিন ০৫টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন

“ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারেশনঃ কমপ্লিট গাইড ২০২২” বইটি কিনতে ক্লিক করুন

 

Leave a Comment

সম্পর্কিত ব্লগগুলো পড়ুন

Rokomari-blog-Logo.png
Join our mailing list and get the latest updates
Loading