সর্বশ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হলো নামাজ। নামাজ ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ। ঈমানের পরেই নামাজের স্থান। প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক নারী-পুরুষের ওপর দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। নামাজ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে মুক্তির একমাত্র সোপান। তেমনি মানসিক উৎকর্ষ লাভের পাশাপাশি শারীরিক সুস্থতা লাভেরও উত্তম উপায় হলো নামাজ। নামাজের উপকারিতা শুধু বাহ্যিক নয়; বরং এটি একটি অতুলনীয় ইবাদত, যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার এক গভীর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। নামাজের গুরুত্ব এতই বেশি, যে কারণে পবিত্র কুরআনের ৮৩ স্থানে বিভিন্নভাবে নামাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর নামাজের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘অতএব দুর্ভোগ সেসব নামাজির, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বেখবর।‘ [সুরা মাউন : ৪-৫] অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে, ‘নিঃসন্দেহে নামাজ যথেষ্ট কঠিন কাজ, তবে যাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়ভীতি আছে তাদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়।’ [সুরা বাকারা : ৪৫]

ঈমানের পর নামাজই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুল সা. এর হাদিস দ্বারাও নামাজের গুরুত্বের বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। কেননা তিনি নামাজকে মুসলিম ও অমুসলিমের মধ্যে পার্থক্যকারী আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘মুমিন ব্যক্তি ও মুশরিক-কাফিরের মধ্যে পার্থক্য নামাজ ত্যাগ।’ [সহিহ মুসলিম : হাদিস ৮২] তাছাড়া সন্তান বালেগ হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে নামাজের নির্দেশ দিতে বলেছে ইসলাম। যেমন এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে নামাজের নির্দেশ দাও। তাদের বয়স দশ বছর হওয়ার পর নামাজের জন্য প্রহার করো এবং তাদের বিছানা পৃথক করে দাও।’ [সুনানে আবি দাউদ : হাদিস ৪৯৫] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘তোমরা সন্তানদের নামাজের প্রতি যত্নবান হও এবং তাদের ভালো কাজে অভ্যস্ত করো। কেননা কল্যাণ লাভ অভ্যাসের ব্যাপার।’ [সুনানে বায়হাকি : হাদিস ৫০৯৪] হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, ‘সন্তান যখন ডান ও বাঁ পার্থক্য করতে শেখে, তখন তাকে নামাজ শেখাও।‘ [মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : হাদিস ৩৫০৪]
অনেক ফজিলতপূর্ণ একটি ফরজ ইবাদত হলো নামাজ। পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে একজন মুমিন ব্যক্তি শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক অনেক সম্মান ও উপকার পেয়ে থাকেন। নামাজে যেমন রয়েছে ইহকালীন উপকার তেমনি রয়েছে পরকালীন কল্যাণ।

নামাজের ইহকালীন উপকারিতা
নামাজের পূর্বশর্ত হলো পবিত্রতা। একজন ব্যক্তিকে নামাজ আদায় করতে হলে প্রথমে পবিত্রতা অর্জন করতে হয়। এই পবিত্রতা অর্জন সাধারণত নামাজের পূর্বে অজু দ্বারা করা হয়। আর পাঁচওয়াক্ত নামাজে পাঁচবার অজুর মাধ্যমে যে পবিত্রতা অর্জন করা হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। কেননা অজুর দ্বারা হাত-পা ও চেহারায় লেগে থাকা ধুলো-বালি ও জীবানু নাশ হয়। তাতে চর্মরোগসহ অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। বর্তমানে বৈশ্বিক মহামারি করোনা থেকে নিষ্কৃতির জন্য স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সময়ে সময়ে হাত-পা ধোয়ার কথা বলছেন। অথচ অজুর মাধ্যমে অনায়াসেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার হয়ে যায়।
দৈনিক পাঁচওয়াক্ত নামাজে শরীর অনেক নাড়াচাড়া করতে হয়। অনেকেই স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য নিয়ম করে নিয়মিত ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করে থাকেন। যদিও ব্যায়াম বা শরীরচর্চা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী একটি বিষয়, কিন্তু সঠিক নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায়ে শরীরের যে কসরত হয় তার চেয়ে উত্তম ব্যায়াম বা শরীরচর্চা চিকিৎসা বিজ্ঞান আজও দিতে পারেনি, পারবেও না কোনো দিন। সুতরাং যারা যথাযথভাবে পাঁচওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন তাদের জন্য আলাদা ব্যায়াম বা শরীরচর্চা করা লাগে না। কারণ নির্ভুল নামাজ আদায় সর্বোত্তম ব্যায়াম বা শরীরচর্চা।
নিয়মিত নামাজ আদায়কারী ব্যক্তিকে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য ভোরে ঘুম থেকে জাগতে হয়। তারপর তাকে হেঁটে হেঁটে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে হয়। এই যে হেঁটে মসজিদে যাওয়া ও সকালের মৃদুমন্দ হাওয়া উপভোগ করা- তা স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ কথা অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেছেন। তাছাড়া সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে সিক্ত হওয়া এবং কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করার ব্যাপারে বিজ্ঞ চিকিৎসকগণ পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অথচ ফজরের ফরজ নামাজ আদায়ের কল্যাণে তা সহজেই আদায় হয়ে যায়।
পাঁচওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে আদায় করলে সময়ানুবর্তিতা ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়। তাই নিয়মিত নামাজি ব্যক্তি কর্তব্যে অবহেলা এবং অনিয়ম প্রদর্শন করতে পারেন না। নামাজ আদায়ের মাধ্যমে জীবন সুন্দর ও শৃঙ্খলিত হয়। নামাজি ব্যক্তি নিরহঙ্কার ও বিনয়ী হয়। কেননা নামাজে আল্লাহর সামনে বিনয়ী হয়ে দাঁড়াতে হয় এবং সুশৃঙ্খলভাবে আদায় করতে হয়। তাই নামাজি ব্যক্তি সর্বদা বিনয়ী, দায়িত্বে সচেতন ও ন্যায়বান হন। সমাজ ও মানুষের চোখেও তিনি সম্মানের পাত্র হন।

নিয়মিত নামাজ আদায় করলে কোনো মানুষ বিকারগ্রস্ত থাকতে পারে না। নামাজে পরস্পর সম্পর্ক, সহানুভূতি, ভালোবাসা সৃষ্টি ও বৃদ্ধি পায়। কেননা একই এলাকা বা মহল্লার লোকজন যখন মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন তখন পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা হয়। একজন আরেকজনের সুখ-দুখ সম্পর্কে জ্ঞাত ও কল্যাণকামী হন। নামাজের কল্যাণে একে অপরের সঙ্গে এই যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতা সৃষ্টি- তাতে করে একজন মানুষ মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন।
নামাজের কল্যাণে আল্লাহ তায়ালা মনের অশান্তি ও অস্থিরতা দূর করে দেন। নামাজি ব্যক্তি মানসিক ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করেন। নামাজের উসিলায় আল্লাহ তায়ালা বান্দার রিজিকে প্রসস্ততা দান করেন এবং কামাই-রোজগারে বরকত ও কল্যাণ দান করেন। বিভিন্ন বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত থেকে রক্ষা করেন। চেহারায় নুর ও লাবণ্যতা দান করেন। এছাড়াও নামাজের মাধ্যমে রয়েছে ইহকালীন আরো অনেক উপকারিতা।
নামাজের পরকালীন উপকারিতা
নামাজ আদায়ের পরকালীন উপকারিত ও পুরস্কার সম্পর্কে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘যারা নামাজ কায়েম করে এবং আমার দেওয়া রিজিক থেকে ব্যয় করে, তারা হলো সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে মর্যাদা, ক্ষমা ও সম্মানজনক রিজিক।‘ [সুরা আনফাল : ৩-৪] অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, `যারা তাদের সালাতসমূহের হিফাজতকারী, মূলত এরাই হবে জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারী এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে থাকবে।’ [সূরা মুমিনুন : ৯-১১]

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত পাঁচওয়াক্ত নামাজ যত্নের সাথে আদায় করবে, কেয়ামতের সময় এ নামাজ তার জন্য আলো হবে, তার ঈমান ও ইসলামের দলিল হবে এবং তার নাজাতের ওসিলা হবে। আর যে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত নামাজ আদায় করবে না, কেয়ামতের বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে নামাজ তার জন্য আলো হবে না, দলিল হবে না এবং সে আজব ও শাস্তি থেকে রেহাইও পাবে না।’ [মুসনাদে আহমদ : হাদীস ৬৫৭৬]
এক হাদিসে নবীজি সা. ইরশাদ করেন- ‘পাঁচওয়াক্ত নামাজ আল্লাহ ফরজ করেছেন। যে ব্যক্তি যথানিয়মে অজু করবে এবং যথাসময়ে নামাজ আদায় করবে, উত্তমরূপে রুকু সিজদা করবে এবং খুশুখুজুর সঙ্গে নামাজগুলো পড়ে যাবে, তার জন্য আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা রয়েছে, তিনি অবশ্যই তাকে ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু যে ব্যক্তি যথাযথভাবে নামাজ আদায় করবে না তার জন্য আল্লাহ পাকের কোনো ওয়াদা নেই। চাইলে তাকে তিনি শাস্তি দিতে পারেন, ক্ষমাও করতে পারেন।’ [সুনানে আবু দাউদ : হাদিস ৪২৫] রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘অন্ধকারে মসজিদে গমনকারীর জন্য কিয়ামতের দিন পূর্ণাঙ্গ আলো লাভের সুসংবাদ দাও।’ [সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৬১]
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি নামাজ পড়ে মসজিদ হতে বের হয়, কিন্তু পরবর্তী নামাজে শরীক না হওয়া পর্যন্ত তার অন্তঃকরণ মসজিদের দিকেই থাকে এবং সে যথাসময়ে নামাজ সম্পন্ন করে, সে ব্যক্তি কিয়ামতের কঠিন দিবসে আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাবে।’ [সহিহ বুখারি : হাদিস ৬১১৪, ৬৪২১]

হযরত হানজালা উসাইদি রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাঁচওয়াক্ত নামাজ যথাযথ পাবন্দির সাথে আদায় করে, উত্তমরূপে অজু করে, সময়ের প্রতি খেয়াল রাখে, রুকু-সিজদা ঠিকমতো আদায় করে এবং এভাবে নামাজ আদায়কে নিজের ওপর আল্লাহ তায়ালার হক মনে করে, তবে জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম করে দেওয়া হবে।’[মুসনাদে আহমাদ ৪/২৬৭ পৃ.] আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সঠিকভাবে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন উপকারিতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
সঠিক নিয়মে নামাজ আদায় করতে যে বইগুলো পড়তে পারেন।