ইসলামের শাসন ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিক। একের পর এক রাজ্য জয় করছে ইসলামের বীর সেনারা। মিশর, লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, মরক্কো প্রভৃতি দেশের বিজয়াভিজান ইতিমধ্যে সম্পন্ন। মুসলিম সেনারা পৌছে গিয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে। এখন তাদের সামনে দুইটি পথ খোলা। হয় দিক পরিবর্তন করে উত্তর অভিমুখি হয়ে জাবালে তারিক (জিব্রাল্টার প্রণালী) পারি দিয়ে স্পেন ও পর্তুগাল তথা ততকালীন আন্দালুসে প্রবেশ করা, কিংবা সম্মুখ পানে আফ্রিকার সুবিশাল সাহারা মরুভূমির দিকে এগিয়ে যাওয়া। মুসলিমরা কখনোই ভুখণ্ড জয় করার জন্য বিজয়াভিযান পরিচালনা করেনি। তাদের ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছা প্রতিটি মানুষের মাঝে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত ছড়িয়ে দেওয়া। এরই প্রেক্ষিতে ৯২ হিজরিতে উমাইয়া শাসনামলে বিজিত হয় ততকালীন ‘আন্দালুস’। যা মুসলিম শাসনের অধিনে ছিল হিজরি ৮৯৭ পর্যন্ত অর্থাৎ ৭১১ সাল থেকে ১৪৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা আন্দালুস শাসন করেছি।
আতীত কালে অসভ্য কিছু জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে সহ ইউরোপের উত্তর স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে এসে আগ্রাসন চালিয়ে আন্দালুস দখল করে নিয়েছিল এবং দীর্ঘকাল ধরে এ অঞ্চলেই বসবাস করছিল। অবশ্য কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে এসব জনগোষ্ঠী জার্মানী থেকে এসেছিল। এ জনগোষ্ঠীকে ভান্ডাল গোত্র বলা হতো। আর এর বাসিন্দাদের নামের সঙ্গে মিল রেখে এ ভুখণ্ডকে বলা হতো ‘ভান্ডালুসিয়া’। আন্দালুস মূলত এই ভান্ডালুসিয়া শব্দেরই অপভ্রংশ। কালের বিবর্তনে ‘ভান্ডালুসিয়া’ প্রথমে ‘আন্দালুসিয়া’। এরপর ‘আন্দালুস’ রূপ ধারণ করে।
আন্দালুস একসময় ছিল মুসলিম বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র। জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখা-সংস্কৃতি, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, স্থাপত্য-প্রকৌশলসহ সভ্যতার বিচিত্র সব অঙ্গনে মুসলিম আন্দালুসের অবদান এত অধিক যে, নিশ্চিত করেই বলা চলে, সভ্যতা ও পৃথিবী মুসলিম আন্দালুসের কাছে চির ঋণী হয়ে আছে। ইউরোপের মানচিত্রে মুসলিম আন্দালুসের অভ্যুদয় ছিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে যুগান্তকারী এক ঘটনা। আন্দালুসে ইসলামের আগমনের পূর্বে আজকের সভ্য ইউরোপ ছিল চিন্তা ও বিশ্বাস, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, জীবনাচার ও সামাজিক রীতি সবক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ একটি অঞ্চল। হানাহানি, অরাজকতা, মূর্খতা ও প্রবৃত্তি পূজা-ই ছিল সমকালীন ইউরোপের বৈশিষ্ট্য। মুসলিম আন্দালুস-ই ইউরোপকে দেখিয়েছিল আলোকিত সভ্যতার পথ সমৃদ্ধির ঠিকানা। The Making of Humanity গ্রন্থের লেখক রবার্ট ব্রিফল্ট (Robert Briffault) এর মতে-
ইউরোপ উন্নতি ও অগ্রগতির এমন কোন অঙ্গন নেই, যেখানে নেই আন্দালুসের ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সমান অবদান।
আন্দালুসের ইতিহাস ৮০০ বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ইতিহাসের এই বীরত্বগাথা অধ্যায়ের মহান আল্লাহ তা’আলার এ বিধানটি এতটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যা অন্য কোন ইতিহাসের ক্ষেত্রে হয়নি। আন্দালুসের ইতিহাসের প্রথম দিকটা ছিল গৌরবময় উত্থান ও জ্ঞান চর্চার উচ্চ শিখরে আরোহণের, আর শেষ দিকটা ছিল বেদনাবিধুর পতনের।
খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে উত্তর আফ্রিকা উমাইয়া খেলাফতের অধিনে আসে। ৬৯৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানী কার্থেজ থেকে বাইজেন্টাইন বিতাড়িত হয়। তিউনিসে ইসলামের আগমন ঘটে এবং সেখানে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের অল্প পরেই মুসলমানরা আলজেরিয়া হয়ে মরক্কো প্রবেশ করেন। মরক্কোসহ উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরেই মুসলমানরা মুসা বিন নুসায়ের এবং তার অধীনস্থ সেনাপতি তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে স্পেনে অভিযান পরিচালনা করেন। প্রথম হিজরি শতাব্দীর শেষের দিকে তথা খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর শুরুতে মুসলমানদের স্পেন বিজয় আইবেরীয় উপদ্বীপের ইতিহাসের পাতায় এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
মুসলমানদের কাছে সম্পদের চেয়ে আদর্শ অনেক বড়। তাদের সামরিক অভিযানের মূল উদ্দেশ্য মাজলুম মানবতাকে জুলুমের নিগড় থেকে উদ্ধার করে শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় দেওয়া। কুফরি ও শিরকের ছায়ায় আচ্ছন্ন জাতিকে তাওহিদের আলোকময় জীবনের সিদ্ধান্ত দেওয়া। মানুষের গোলামী থেকে মুক্তি দিয়ে আল্লাহর গোলামীর মর্যাদা পূর্ণ আসনে আসীন করা। তাই যেখানেই মুসলমানদের বিজয়ের হেলালি নিশান উড্ডীন হতো সেখানেই শান্তি ও স্বস্তির সুবাতাস বইতে শুরু করত। ফলে বিজিত সম্প্রদায় বিজেতা মুসলমানদের দিকে ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাত। যেসব অঞ্চল তখনো মুসলমানদের কর্তৃত্ব বলয়ের বাইরে ছিল, সেসব অঞ্চলের নিপীড়িত ও মাজলুম জনতা তাদের অঞ্চলে মুসলমানদের আগমন কামনা করতেন। স্পেনের অবস্থাও সেকালে অনেকটা এমন ছিল।
সমাজের এলিট শ্রেণী, যাজক ও সামরিক অভিজাতরাই ছিল দেশের ভূ-সম্পত্তির প্রকৃত মালিক। সাধারণ জনগণ ছিল ভূমিদাস। এ ভূমিদাস ও ক্রীতদাসদেরকে নিয়েই গঠিত হয়েছিল স্পেনের নিম্নশ্রেণী।
স্পেনে তখন ধর্মীয় স্বাধীনতা ছিল না। ভিজিগথরা নিজেদেরকে খ্রিষ্টধর্মের আর্য শাখাভুক্ত বলে দাবি করত। সে সময় হতেই স্পেন গোঁড়া ধর্মমতে বিশ্বাসী ও পরমত অসহিষ্ণু দেশ হয়ে ওঠে, এই অন্ধ ধর্মে বিশ্বাসীরা অন্য ধর্মের উৎখাত ও উচ্ছেদকে নিজ ধর্মের সেবা বলে মনে করত।

৯২ হিজরির ২৭ রমজান মোতাবেক ৭১১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মে ওয়াদি লাক্কার উপত্যকায় (Rio-Barbate) লাগুন-দে-জান্দা নদীর তীরে মেডিনা ও সিডনিয়া শহর ও হ্রদের মধ্যবর্তী স্থানে তারিক ও রডারিক বাহিনীর মধ্যে তুলুম যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ভয়াবহ ও রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ সাতদিন স্থায়ী হয়। মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের মুখে খ্রিষ্টান বাহিনী ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। হাজার হাজার গথিক সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। রাজা রডারিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করতে গিয়ে নদীতে নিমজ্জিত হয়ে মারা যায়। তারিকের এ বিজয় আইবেরীয় উপদ্বীপে মুসলিম সাম্রাজ্যের ভিত্তি তৈরী করে। ইউরোপের ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন এক অধ্যায়। অন্ধকারাচ্ছন্ন ইউরোপ প্রবেশ করে আলোর ভুবনে।
তারিক উত্তর আফ্রিকার সেনাপতি মুসা বিন নুসায়েরকে শত্রুপক্ষের মারাত্মক পরাজয় ও নিজের বিরাট সাফল্যের কথা এবং স্পেনের সার্বিক অবস্থা জানান। সেনাপতি মুসা এ খবর পেয়ে তারিকের কাছে একটা বার্তা প্রেরণ করেন। তাতে তারিককে নির্দেশ করা হয়েছিল, ‘সেনাপতি মুসা না আসা পর্যন্ত যেন আর কোনো অভিযান না চালানো হয়’
কিন্তু দুরদর্শী তারিক পরিস্থিতি বুঝে ও ভবিষ্যৎ পরিণাম পর্যালোচনা করে সামনের অভিযানের জন্য একটা পরিকল্পনা তৈরী করেন। কালক্ষেপণ না করে সে পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান অব্যাহত রাখেন। কারণ দেরি করলে পরাজিত খ্রিষ্টানরা সৈন্য সংগ্রহ করে আবার আক্রমণ করতে পারে। এভাবে তারিক একের পর এক স্পেনের গুরুত্বপূর্ণ শহর বন্দর দখল করতে থাকেন। তিনি এলভিরা, আর্কিডোনা ও এচিজা দখল করেন। বিনা বাধায় টলেডোর পতন হয়। ভ্যালেন্সিয়া ও আল্মেরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকাও মুসলমানদের অধিকারে আসে। এ সময় মুগীস নামক সেনা নায়কের নেতৃত্বে ৭০০ অশ্বারোহীর একটি দল কার্ডোভা নগরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়।
মুসলিম সৈন্যদের চৌকস হামলার ফলে শহরের প্রায় সবাই আত্মসমর্পন করে। আরেকটি বাহীনি পূর্ব স্পেনের মালাগা ও অরিহিউলা জয় করে। এভাবে একে একে রাজধানী টলেডো ও মুরসিয়া পতনের পর মুসলিম বাহিনী প্রচুর ধন-রত্ন লাভ করে। তারা একটি গীর্জা থেকে প্রায় ২৪ টি মহামূল্যবান স্বর্ণের রাজমুকুট উদ্ধার করেন। স্পেনের রাজধানী টোলেডো বিজিত হওয়ার কারণে অন্যান্য অঞ্চল বিজয় করা বেশি কষ্টকর হবে না এই ভেবে মুসলমানদের আনন্দের সীমা রইল না।
এবার মুসলিম সেনাপতি বিজিত অঞ্চল গুলোতে সুষ্ঠু ইসলামি শাসন কায়েমের জন্য পদ মর্যাদা ও যোগ্যতা অনুসারে গথিক রাজ বংশীয়দেরকে শাসনকার্যে নিযুক্ত করেন। উইটিজার পুত্র অচিলাকে ইসলামি শাসনের দায়িত্ব অর্পণ করেন। আর টলেডোর গভর্নর হিসেবে বিশপ অশাপকে এবং সিউটার গভর্নর হিসেবে কাউন্ট জুলিয়ানকে নিয়োগ করেন। অন্যান্য অঞ্চল গুলোতে যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদেরকে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করেন। এভাবে প্রায় অর্ধেক স্পেনে মুসলিম রাজত্ব বিস্তার হয়।
আন্দালুসের দীর্ঘ ইতিহাস পরিক্রমায় অনেক ঘটনাই ঘটেছে। যার কিছু অংশ তো ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে, কিছু অংশ দূর্ভাগ্যক্রমে আলোচনায় আসেনি। যতটুকু ইতিহাসে স্থান পেয়েছে, তাও আবার সত্য বিদ্বেষি ও কুচক্রিরা বিকৃত করে উপস্থাপন করেছে। সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে আর মিথ্যাকে সত্যের প্রলেপ দিয়ে কাল্পনিক ও অবাস্তব ইতিহাস তৈরি করেছে।
আরবী ইতিহাসের বিদগ্ধ লেখক ড. রাগিব সারজানি রচনা করেছেন ‘আন্দালুসের ইতিহাস‘ বইটি। দুই খণ্ডে প্রকাশিত বইটিতে ইতিহাসের পাতা থেকে বিস্মৃতপ্রায় আন্দালুসের ইতিহাসকে যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে সত্যিকার স্বরূপে তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন আন্দালুস বিজয়ের ইতিহাস, ততকালীন অবস্থা এবং ঐতিহ্যের আধার আমাদের আন্দালুসকে হারানো কাহিনী।
ইসলামি ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক বই সমূহ পেতে ক্লিক করুন !
2 thoughts on “আন্দালুসের ইতিহাস : ৮০০ বছরের গৌরব”
“যা মুসলিম শাসনের অধিনে ছিল হিজরি ৮৯৭ পর্যন্ত অর্থাৎ ৭১১ সাল থেকে ১৮৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০০ বছরের বেশি সময় ধরে আমরা আন্দালুস শাসন করেছি। ”
The date would be 1492 in the above line. The writer must be mistakenly written it in Bangla “1892”.
They have corrected the text.